চিনির বাজার কেবল অস্থিরতার দিকে এগুচ্ছে। প্রকৃত দামের থেকে বাড়তি দামে বাজারে বিক্রি হচ্ছে চিনি। ডলার সংকটসহ নানান কারণ সামনে টেনে গত সপ্তাহে চিনির দাম কেজিতে ১২ টাকা বাড়িয়ে নিয়েছেন মিল মালিকরা। ফলে প্রতি কেজি চিনির মূল্য ১০৮ হওয়ার কথা। কিন্তু বাস্তবে চিত্র উল্টো। পাইকারী ও খুচরা বাজারে চিনির বিক্রি হচ্ছে এর বেশি দামে। এসব ব্যবসায়ীদের বক্তব্য, মিল থেকে চিনির সরবরাহ নেই। বাণিজ্য মন্ত্রণালয় এ বিষয়ে অনেকটা নীরব। খুচরা বিক্রেতারাও ক্রয়মূল্যের অধিক দামে পণ্য বিক্রি করে যাচ্ছে। ভোক্তা অধিকার বলছে, চিনি এখনো আটকে আছে সিন্ডিকেটে। বাজার তদারকি করে অবৈধ মজুতও পেয়েছেন তারা। এমতাবস্থায় সরকারের বাণিজ্য মন্ত্রণালয় জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মাধ্যমে কিছু বাজার তদারকি করলেও মিল মালিকদের বিরুদ্ধে কার্যত কোনো ব্যবস্থা নিচ্ছে না।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তরের মহাপরিচালক এএইচএম সফিকুজ্জামান বলেন, ১৭ নভেম্বর একসঙ্গে তারা চিনি ও তেলের দাম বাড়িয়ে নিলো। এরপর বাজারে তেলের সরবরাহ রাতারাতি স্বাভাবিক হয়েছে। কিন্তু এখন চিনি দিচ্ছে না। যদিও তারা (মিল মালিকরা) বলছে, প্রতিদিন আগের মতো চিনি মিলগেট থেকে দেওয়া হচ্ছে। তাহলে সেটা যাচ্ছে কোথায়। ‘শেষ দু’দফা দাম বাড়ানোর আগে তারা প্রতিশ্রুতি দিয়েছিল যে সরবরাহ স্বাভাবিক করবে। প্রধানমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠকেও তারা সেটা বলেছে। কিন্তু এখন চিনি নিয়ে সিন্ডিকেট করছে। সেজন্য আমরা বাজারে নেমেছি।’ খুব শীগ্রয় এর সমাধান চলে আসবে।
ডলারের বিপরীতে টাকার মান কমে যাওয়া, গ্যাস সংকটে উৎপাদন ব্যাহত হওয়াসহ বিভিন্ন কারণ দেখিয়ে গত সপ্তাহে বাণিজ্য মন্ত্রণালয়ে তেল ও চিনির দাম বাড়ানোর প্রস্তাব দেন পরিশোধনকারীরা। সেখানে চিনির দাম কেজিতে ১২ টাকা বাড়িয়ে ১০৮ টাকা (প্যাকেট) করার ঘোষণা দেন তারা। বাজারে বাড়তি দামের চিনি বিক্রি শুরু হয়েছে বৃহস্পতিবার থেকে।
যদিও বেশ কিছুদিন ধরেই মিল থেকে সরবরাহ কমিয়ে দেওয়ায় বাজারে তেল ও চিনির সংকট দেখা দিয়েছিল। এখন দাম বাড়ার পরে তেলের সংকট কিছুটা কেটেছে। তবে চিনি এখনো মিলছে না। আর সেই সুযোগে খুচরা দোকানগুলোতে আগের নির্ধারিত দরের চেয়ে বাড়তি দামে পণ্যটি বিক্রি করছে।
মঙ্গলবার (২২ নভেম্বর) বিকেলে সেগুনবাগিচা বাজার ঘুরে দেখা যায়, ফ্রেশ ব্র্যান্ডের চিনির এক কেজির প্যাকেটের গায়ে সর্বোচ্চ খুচরা মূল্য লেখা হয়েছে ১০৮ টাকা। তারপরেও সেই চিনি ১২০ টাকা দর হাঁকছেন খুচরা বিক্রেতা। অনেকে এখনো দাম লেখা চিনি কেটে খোলা হিসেবে ওই দামে বিক্রি করছেন।
নতুন দর ঘোষণা করে নতুন দামের চিনি সরবরাহ করছেন মিল মালিকরা। ব্যবসায়ীদের অভিযোগ, সরবরাহ সংকটও ধরে রেখেছেন তারা! দুয়ে মিলে ক্রেতারা ন্যায্যমূল্য দূরের কথা, বাধ্য হয়ে কেজিপ্রতি ১২ টাকা পর্যন্ত বেশি দিয়ে কিনছেন নিত্যপ্রয়োজনীয় পণ্যটি।
কুমিল্লা স্টোরের বিক্রেতা সুমন বলেন, চিনি দেয় না কোম্পানিগুলো। সামান্য কিছুটা পেয়েছি। কিন্তু সেটা বাড়তি দামে কেনা হয়েছে। প্যাকেটের গায়ের দামে আমাদের দিয়েছে। সেজন্য বেশি দামে বিক্রি করছি।
এদিকে পাইকারি ব্যবসায়ীরাও চিনির এ সংকটের কারণ হিসেবে চিনি পরিশোধনকারীদের দুষছেন। কারওয়ান বাজারে পাইকারি চিনি বিক্রেতা সোনালী ট্রেডার্সের স্বত্বাধিকারী আবুল কাশেম জাগো নিউজকে বলেন, এসও (সাপ্লাই অর্ডার) দিয়েও মিল চিনি দিচ্ছে না। এক গাড়ি পেলেও ১০-১৫ দিন যাচ্ছে মিলগেটে। মিল মালিকরা সরবরাহ ঠিকমতো দিচ্ছেন না বলেই পাইকারি বাজারে দাম বেড়েছে।
তবে চিনির মূল্যবৃদ্ধির বিষয়ে অন্যতম সরবরাহকারী প্রতিষ্ঠান সিটি গ্রুপ ও মেঘনা গ্রুপের প্রতিনিধিদের সঙ্গে যোগাযোগ করেও মন্তব্য পাওয়া যায়নি। নাম না প্রকাশ করার শর্তে এক কর্মকর্তা দাবি করেন, আগের মতোই প্রতিদিন সরবরাহ দেওয়া হচ্ছে। পাইকারি ব্যবসায়ীরা চিনি মজুত রাখছেন।
এ কর্মকর্তার কথার সূত্র ধরে প্রশ্ন করা হলে পাইকারি পণ্যের আড়ত পুরান ঢাকার মৌলভীবাজারের ব্যবসায়ী সমিতির সাধারণ সম্পাদক গোলাম মাওলা বলেন, বাজারে চিনির সরবরাহ নেই, মজুতের প্রশ্ন আসছে কীভাবে। আমাদের হাতে যতটুকু এসও আছে সেটাও দিচ্ছে না। দিলেও প্রতিটি গাড়ি অন্তত ১০ দিন বসিয়ে রেখে চিনি দিচ্ছে। সেজন্য আমাদের লোকসান হচ্ছে। বসে বসে প্রতিটি গাড়িতে দিনে তিন হাজার টাকা করে লোকসান।
এ ব্যবসায়ী আরও বলেন, গুটিকয়েক চিনি পরিশোধনকারী কোম্পানি সারাদেশকে জিম্মি করে সিন্ডিকেট করছে।
ওই বাজারের চিনি ব্যবসায়ী নন্দী বলেন, চিনির দাম বাড়ানো হলেও খুচরা বিক্রেতাদের লাভের হার কমিয়ে দিয়েছে কোম্পানিগুলো। প্রতি কেজি চিনিতে দুই টাকা লাভ থাকছে। আগে পাঁচ টাকা ছিল। ফলে বাধ্য হয়ে অনেকে নির্ধারিত মূল্যের বেশি দাম রাখছে।
এদিকে মিল মালিকদের দোষারোপ করলেও পাইকারি ও খুচরা বিক্রেতাদের মজুতের প্রমাণ মিলেছে মঙ্গলবারও। এদিন মোহাম্মদপুর কৃষি মার্কেটে মিলেছে লুকিয়ে রাখা ৫৩০ বস্তা চিনি। গোপন খবরের ভিত্তিতে দুটি দোকানে অভিযান চালিয়ে জাতীয় ভোক্তা অধিকার সংরক্ষণ অধিদপ্তর দুটি প্রতিষ্ঠানের বন্ধ গুদামে এসব চিনি পায়। সেজন্য দুটি প্রতিষ্ঠানকে দেড় লাখ টাকা জরিমানা করা হয়েছে। একই দিনে গাজীপুর জেলার শ্রীপুর উপজেলার মাওনা চৌরাস্তা এলাকায় একটি দোকানে মিলেছে লুকিয়ে রাখা ৫০ বস্তা চিনি।
মোহাম্মদপুরে অধিদপ্তরের সহকারী পরিচালক মাগফুর রহমান বলেন, গুদামের সামনে খালি ড্রাম দিয়ে লুকিয়ে রাখা ছিল এসব চিনি। এগুলো মজুত চিনি। বিক্রি করা হয় না। আমাদের অভিযান অব্যাহত থাকবে এবং যারা এই অবৈধ অপকর্মে লিপ্ত থাকবে তাদের শাস্তির আওতায় আনা হবে।