অমর একুশে বইমেলা উপলক্ষে ‘কিডজ’ এর সঙ্গে সাক্ষাৎকারে নিজের শৈশব–কৈশোরের গল্প শুনিয়েছেন সুমন। সাক্ষাৎকার নিয়েছেন বিডিনিউজ টোয়েন্টিফোরের জ্যেষ্ঠ সহ-সম্পাদক কবি মাজহার সরকার।এবারের মেলায় আপনার নতুন কী বই প্রকাশিত হয়েছে? বিষয়বস্তু কী?এবারের মেলায় আমার একটিই বই বেরিয়েছে ছোটদের জন্য, সেটি হচ্ছে সময় প্রকাশন থেকে ‘ছোটদের সিন্দাবাদ’। আরব্য উপন্যাসের দুঃসাহসী বণিক ও অভিযাত্রী সিন্দাবাদের রোমাঞ্চকর অভিযানের সাতটি গল্প রয়েছে এতে। তবে জানামতে মুক্তিযুদ্ধসহ বিভিন্ন বিষয়ের আরও কয়েকটি পুরনো বই মেলায় কিছু কপি পাওয়া যাওয়ার কথা।বইমেলার কোন দিকটা সবচেয়ে বেশি আকর্ষণ করে আপনাকে?একসঙ্গে হাজারও বই দেখার সুযোগটাই সবচেয়ে বড় আকর্ষণ। মেলার ভিড়, আড্ডা আমাকে ততটা টানে না। ভিড়, কলরব অন্য মেলায় হোক- বইমেলায় শান্তিতে বই নিয়েই থাকতে চাই।আপনার বই পড়া শুরু কীভাবে? প্রথম পড়া বই কোনটি? শৈশব-কৈশোরে পড়া কোনো বই কি এখনও মনে পড়ে?আমার বাবা আবু কায়সার ষাট দশকের উল্লেখযোগ্য কবি, শিশুসাহিত্যিকদের একজন। তার বইয়ের ভালো সংগ্রহ ছিল, সংখ্যায় খুব বেশি না হলেও মানে যথেষ্ট আকর্ষণীয় ছিল। কাজেই বাড়িতে বই পড়ার আবহ বরাবরই ছিল। বই ছিল ছোটবেলার ধ্যানজ্ঞান। প্রথম বই মনে নেই। শিশুকিশোর উপযোগী যা পেয়েছি তা-ই পড়ে ফেলতাম। না বুঝে পড়েছি কিছু ‘বড়দের বই’-ও। প্রথম দিকে পড়া বইগুলোর মধ্যে রবীন্দ্রনাথের ‘আমার ছেলেবেলা’, আলী ইমামের ‘তিতিরমুখীর চৈতা’, সত্যজিৎ রায়ের ফেলুদার ‘বাদশাহী আংটি’, উপেন্দ্রকিশোর রায়চৌধুরীর বিভিন্ন শিশুতোষ রচনা, আমাদের হাবীবুর রহমান, কাইজার চৌধুরী, শাহরিয়ার কবির এদের বিভিন্ন বই পড়েছি। অ্যাডভেঞ্চার কাহিনি বিশেষ পছন্দের ছিল। মাহমুদুল হকের ‘কুশল ও চিক্কোর মারণ কাবুক’ প্রিয় বইয়ের একটি ছিল, ‘ধানশালিকের দেশ’ বা ‘শিশু’ পত্রিকার ঈদ বা কোন বিশেষ সংখ্যায় ছাপা হয়েছিল প্রথম। মনে পড়ে বুলবন ওসমানের ‘উটকো’। বুনো কুকুরের আশ্রয়ে বেড়ে ওঠা মানবশিশুর রোমাঞ্চকর গল্প ছিল সেটা। সিলেট-খাসিয়া পাহাড় অঞ্চলের পটভূমিতে লেখা দুর্ধর্ষ অ্যাডভেঞ্চার হেমেন্দ্রকুমার রায়ের ‘যকের ধন’ ছিল অতি প্রিয় বই। ‘শিশুসাহিত্য সম্রাট’ হিসেবে পরিচিত ছিলেন হেমেন্দ্রকুমার রায়। বিজ্ঞান, নৃতত্ত্ব ইতিহাস- এরকম বহু কিছুর প্রাথমিক ধারণা তার বই পড়ে পেয়েছিলাম। গত শতকের সম্ভবত চল্লিশ পঞ্চাশের দশকে তিনি মঙ্গলগ্রহের কল্পিত বাসিন্দাদের পৃথিবীতে হানা দেওয়ার গল্প লিখেন। এমনকি তার নায়কদের সেই গ্রহে পাঠিয়েছিলেন! মঙ্গলের এলিয়েনরা পরীক্ষার জন্য তাদের ধরে নিয়ে গিয়েছিল।জুল ভার্নের ‘দ্য স্টিম হাউস’ উপন্যাস পড়েছিলাম ভালো করে না বুঝেই। মজার ব্যাপার ‘রাউন্ড দ্য ওয়ার্ল্ড ইন এইটি ডেজ’ এর মতো এখানেও ভারতের প্রেক্ষাপট। ব্রিটিশবিরোধী বিপ্লবী নানা সাহেব চরিত্রটা সেখানে প্রথম পড়ি। কাহিনির বিশদ মনে নেই। যান্ত্রিক একটা হাতির আকারের গাড়িতে যাত্রা চলেছিল মূল পাত্রপাত্রীরা- এটুকু মনে আছে। তবে পরে জুল ভার্ন পড়ায় আগ্রহ উস্কে দিয়েছিল বইটা। জসিম উদদীনের ‘বাঙালির হাসির গল্প’ ছিল পছন্দের। বিশেষ করে গ্রামে নানাবাড়ি গেলে অনেককে পড়ে শোনাতে হতো। নানাবাড়িতেই পড়েছিলাম বরিস লাভরেনিওভের উপন্যাস ‘একচল্লিশ নম্বর’। সোভিয়েত সমাজতন্ত্র, বিপ্লবের বিষয়ে ঝাপসা জ্ঞানলাভ সেটাই প্রথম। উপেন্দ্রকিশোর রচনাবলী থেকে ‘মহাভারত’ পড়েছিলাম। তার একের পর এক গল্প দিয়ে সাজানো কাহিনি মজা লাগতো। কিন্তু খেই হারিয়ে ফেলতাম। কষ্ট করে অনেকটা পড়ে ফেলেছিলাম কারবালার শোকাবহ আখ্যান ‘বিষাদ সিন্ধু’-ও। কলকাতার ‘দেব সাহিত্য কুটীর’ ব্রিটিশ আমল থেকে শারদীয় পুজোর সময় বার্ষিকী বের করতো। তাতে থাকতো দুই বাংলার শ্রেষ্ঠ সাহিত্যিকদের লেখা। বার্ষিকীগুলো হতো ‘বেনুবীণা’, ‘রঙিন আকাশ’, ‘সোনালী ফসল’, ‘নীহারিকা’, ‘অপরূপা’, ‘নবপত্রিকা’- এরকম দারুণ সব নামে। অনেক মনকাড়া লেখা পড়েছি। এগুলোতে ছিল প্রতুল চন্দ্র বন্দ্যোপাধ্যায় নামে একজন শিল্পীর আঁকা দুর্দান্ত অলঙ্করণ। কিছুদিন আগে কোথাও পড়লাম এই পূর্ববাংলা অর্থাৎ আজকের বাংলাদেশেই জন্মগ্রহণ করেছিলেন এ শিল্পী। সম্ভবত কিছুদিন উত্তরবঙ্গে হাইস্কুল পর্যায়ের লেখাপড়া করেন। পরবর্তী জীবনে তার পরিবার পশ্চিমবঙ্গে চলে যায়। দেশবিভাগ হয়ে সীমান্তের দুইপারের কতজন জ্ঞানীগুণী মানুষই না এভাবে দেশছাড়া হয়েছেন!হাঁদা ভোঁদা, নন্টে ফন্টে, বাঁটুল দ্য গ্রেট খ্যাত নারায়ণ দেবনাথও ছিলেন এই দেব সাহিত্য কুটীরের বার্ষিকী আর রহস্য-রোমাঞ্চকাহিনিসহ নানা বিচিত্র বইয়ের অন্যতম অলঙ্করণ শিল্পী। ‘টিনটিন আর টারজান কমিক্সের ভক্ত ছিলাম। তখন ছিল ‘আনন্দমেলা’ পত্রিকার স্বর্ণযুগ। পত্রিকাটির এখন যা আছে তা অতীতের কঙ্কালও নয়।স্কুলে কেউ কেউ পাঠ্যবইয়ের ভেতর সৃজনশীল বই রেখে লুকিয়ে পড়তো, আপনি কীভাবে পড়তেন? শিশু-কিশোরদের বই পড়ার অভ্যাস গড়তে কী কী করা উচিত বলে মনে করেন?
আমার বই পড়ায় পারিবারিক বাধা ছিল না। তবে আমাদের স্কুলের শিক্ষকরা অনেকেই সাধারণত পাঠ্যবইয়ের বাইরের বই পড়তে উৎসাহিত করেন না। বিশেষ করে ক্লাসে তা লুকিয়ে পড়তে দেখলে মোটেই খুশি হবেন না। বই যাতে লুকিয়ে পড়তে না হয় সেজন্য শিক্ষক, অভিভাবক সবাইকে সচেতন হয়ে কাজ করতে হবে। স্কুলের পাঠাগারগুলো সচল রাখতে হবে, সেখানে ভালো বই থাকতে হবে। সেখানে শিক্ষার্থীরা যাতে নিয়মিত যায় তা নিশ্চিত করতে হবে। এটা তাদের মনন উন্নত করার পাশাপাশি লেখাপড়ার ফল ভালো করতেও সাহায্য করবে। আমি ক্লাস সিক্সে এক বছর পড়েছিলাম জেলার সবচেয়ে পুরনো ঐতিহ্যবাহী স্কুলে। সেখানে ক্লাস ক্যাপ্টেন মাথা গুণে লাইব্রেরি থেকে এক গাদা বই নিয়ে আসতো। শিক্ষক ডেকে ডেকে একেকজনের হাতে একেকটা বই ধরিয়ে দিতেন। যার ভাগ্যে যা উঠত। মনে আছে, একবার আমি যে বই পেয়েছিলাম তা পছন্দ হয়নি বলে কয়েক মাসেও পড়া হয়নি। বাসার কোন এক কোণে পড়ে ছিল যে ফেরত দিতেও ভুলে গিয়েছিলাম। এজন্য আমার বার্ষিক পরীক্ষার ফলই আটকে দেওয়া হয়। বাড়ি গিয়ে বই খুঁজে ফেরত দিয়ে তবে ফল জানতে পারি। এটা বই বিতরণের খুবই দুঃখজনক, হাস্যকর প্রক্রিয়া,আপনার জীবনে কোন শিক্ষক আছেন কি এখনও বেঞ্চে বসে যার ক্লাস করতে ইচ্ছে করে?আমার প্রাথমিক বিদ্যালয়ের শিক্ষকদের খুব মনে পড়ে। বেশিরভাগই কড়া ছিলেন। কেউ কেউ অনেক মারতেনও। তা-ও তারা আমাদের জ্ঞান ও নৈতিকতার ভিত গড়েছেন। অনেকে হয়তো বেঁচে নেই। তাদের সবার কথা শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণ করি।
শৈশব-কৈশোরের প্রিয় কোনো খেলা বা স্কুল পালানোর স্মৃতি?
আমাদের প্রিয় খেলা ছিল ফুটবল। পাড়াজুড়ে দৌড়ঝাঁপ করতাম। অল্পস্বল্প ক্রিকেটও খেলতাম। স্কুলের মাঠে মোরগ লড়াই খেলতাম। ডাংগুলি ও মার্বেল খেলেছি একটু আধটুকু, ভালো পারতাম না। চোর-পুলিশ নামে একটা মজার খেলা ছিল, সেটা বৃষ্টি বা অন্য কারণে ঘরবন্দি সময়ে খুব চলতো। স্কুল তেমন পালাইনি। তবে সম্ভবত হাইস্কুলের সময় ‘টারজান’ চলচ্চিত্র দেখার জন্য টিফিনের পর অসুখের অজুহাতে ভাগার নজির আছে। তখন এত ছাত্রের একসঙ্গে ‘পেটব্যথা’ বা ‘মাথাব্যথা’ হতো যে একবার শিক্ষকরা সম্ভবত কমনরুমে টিভি আনার ব্যবস্থা করেছিলেন। কথাবার্তা হয়েছিল সেটা স্পষ্ট মনে আছে। কাজটা সত্যি করা হয়েছিল কিনা মনে নেই। সেই আশির দশকের কথা,ঢাকাসহ অন্যান্য জেলা শহরগুলোতে শিশুদের জন্য পার্ক, উদ্যান ও খেলার মাঠের সংকট রয়েছে। একটি প্রতিবেদন বলছে, দেশ স্বাধীন হওয়ার পর ঢাকায় নতুন করে কোন পার্ক বা উদ্যান গড়ে ওঠেনি। কেবল বই পড়িয়েই কি ভবিষ্যতের জন্য শিশুদের প্রস্তুত করা সম্ভব?বই পড়লেই চলবে না, খেলাধুলা লাগবে। নাচ, গান, ছবি আঁকা, ক্র্যাফট তৈরি এসবের মধ্য দিয়ে আনন্দের সঙ্গে শিক্ষা কার্যক্রম চালাতে হবে। গাছ, ফুল, পাখি বন্যপ্রাণীসহ প্রকৃতিকে চিনতে জানতে হবে। শুধু সাজানো রিসোর্টে গেলে প্রকৃতি চেনা যাবে না। গ্রামকে চিনতে হবে। তাহলে দেশের ঐতিহ্য বোঝা যাবে। তবে গ্রামও অনেক বদলে গেছে। শিশুরা দূরে থাক তরুণ ও যুবকরা কতজন জোনাকি পোকা দেখেছে নিজ চোখে! পরিবেশ নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। বনভূমি ছাড়াও গ্রামীণ জঙ্গল, ঝোপঝাড় পর্যন্ত সাফ করে ফেলা হচ্ছে। শিশুদের জন্য আমরা কী পরিবেশ রেখে যাচ্ছি সেটা ভাবতে হবে। দেশ স্বাধীন হওয়ার পর পার্ক হয়েছে। কিন্তু খেলার জায়গা, উন্মুক্ত স্থান প্রয়োজনের তুলনায় অতি নগণ্য। পত্রপত্রিকার খবর অনুযায়ী, যা আছে তারও অনেকটা বেদখল বা ব্যবহার উপযোগী নয়। প্রতি পাড়া মহল্লায় জনসংখ্যা অনুপাতে খেলার ছোটবড় মাঠ বা অন্তত কিছু জায়গা বা অবকাঠামো দরকার। মফস্বলে আমার শৈশব কেটেছে। ১০/১১ বছর বয়স পর্যন্ত। তারপর থেকে ঢাকায় বন্দি। আমরা যখন ছোটবেলায় দৌড়ে বেড়াতাম, কার বাড়ির উঠোন, কার পেছন বাড়ি, কার রান্নাঘরের চালে উঠে শর্টকাট মারতাম খেয়াল থাকতো না। বেশিরভাগ বাড়ির সীমানা দেয়াল ছিল না, ছিল না নিরাপত্তা নিয়ে এত ভয়। সেতো খুব বেশিদিন আগের কথা নয়- আশির দশকের কথা বলছি।শিশু-কিশোরদের মানসিক উৎকর্ষ বিকাশে বইমেলা আরও কীভাবে ভূমিকা রাখতে পারে বলে মনে করেন? আপনার কোনো পরামর্শ?‘শিশুপ্রহর’ একটা ভালো আয়োজন। তবে শিশুদের জন্য বইয়ের দামে বিশেষ মূল্য ছাড় বা উপহারের ব্যবস্থা রাখা যায়। শিশুদের বই নিয়ে বিশেষ আয়োজন, বিভিন্ন দেশের শিশুদের পাঠাভ্যাস, পাঠাগার সংস্কৃতি, বইপড়ার আনন্দ ইত্যাদি নিয়ে প্রদর্শনী, প্রামাণ্য চলচ্চিত্র ইত্যাদির আয়োজন হতে পারে। বইয়ের বিষয়বস্তু নিয়ে কুইজের আয়োজন হতে পারে। বইটা হয়তো প্রকাশক বা বাংলা একাডেমি স্পন্সর করল। তবে বাবা-মায়ের নিজের বই পড়ার অভ্যাস না থাকলে মুশকিল। এ বিষয়ে মায়ের ভূমিকাটা বেশি। তারা সময় বা অন্য কারণে বেশি পড়তে না পারেন, কিন্তু শিশুদের যেন বই পড়ায় উৎসাহ দেন। শুধু স্কুলের বই পড়ে সম্পূর্ণ, আলোকিত মানুষ হওয়া যাবে না।ভবিষ্যতে আর কী লেখার বা করার পরিকল্পনা আছে আপনার?মুক্তিযুদ্ধ-ইতিহাস বিষয়ে ও ভ্রমণকাহিনি লেখার ইচ্ছে আছে। ভালো কিছু বিদেশি বই অনুবাদের পরিকল্পনা আছে। অনুবাদ আমার ভালোলাগার একটি কাজ।