এটি রাজশাহী মহানগরের পাঠানপাড়া ঈদগাহ মাঠের দৃশ্য। খোলা মাঠের চারপাশে কাঁথা-বালিশ মুড়িয়ে শুয়ে আছেন শত শত মানুষ।কেউ ঘুমাচ্ছেন, কেউবা আড়মোড়া দিয়ে জেগে উঠেছেন। মাঠের চারদিকে হাঁটাহাঁটি করছেন কেউ কেউ। কোথাও আবার দলবদ্ধভাবে আড্ডা আর খোশ গল্পে মেতে উঠেছেন। মাঠেই চলছে রান্নার আয়োজন। হকাররা চা, বিস্কুট, সিঙ্গাড়া-পুরি, পান-সুপারি নিয়ে পসরা সাজিয়ে বসেছেন। সেখানেও ভিড় করছেন মানুষ।
শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) সকাল ৯টায় রাজশাহীতে বিএনপি গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে এমন দৃশ্য চোখে পড়ে।
রাজশাহীতে বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশের আগে এভাবেই খোলা আকাশের নিচে অবস্থান নিয়েছেন বিএনপির হাজার হাজার নেতাকর্মী। কেউ কেউ মাথার ওপর টানিয়েছেন সামিয়ানা।
গত বুধবার (৩০ নভেম্বর) বিকেলের পরপরই রাজশাহীতে হাজির হয়েছে অনেকে। এখনও ট্রেন ও ট্রাকসহ বিভিন্ন উপায়ে আশপাশের জেলা থেকে রাজশাহীর গণসমাবেশস্থলে আসছেন বিএনপির নেতাকর্মীরা।
রাজশাহী বিভাগের ৮ জেলা ও উপজেলা পর্যায় থেকে আসা নেতাকর্মীরা দুই দিন থেকে সেখানে এমন কষ্ট করেই রাতযাপন করছেন। আর শনিবার (৩ ডিসেম্বর) ঐতিহাসিক মাদরাসা ময়দানে অনুষ্ঠিত হবে এ গণসমাবেশ। সমাবেশকে ঘিরে বিএনপি নেতাকর্মীদের মধ্যে চরম উৎসাহ আর উদ্দীপনা লক্ষ্য করা যাচ্ছে।
সমাবেশে অংশ নিতে পরিবহন ধর্মঘটসহ পথে পথে নানা বাধা উপেক্ষা এখন রাজশাহী বিভাগের আট জেলার বিএনপি নেতাকর্মীরা মাদরাসা ময়দানে আসতে শুরু করেছেন। মাদরাসা মাঠ সংলগ্ন রাজশাহীর হযরত শাহ মখদুম (রহ.) ঈদগাহ মাঠে খোলা আকাশের নিচে নিয়েছেন অবস্থান। শীতের রাতকে উপেক্ষা করে খোলা মাঠে ঘুমাচ্ছেন, সেখানেই করছেন রান্না এবং খাবার ব্যবস্থা।
সমাবেশস্থলে থাকা বিএনপি নেতাকর্মীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, বৃহস্পতিবার থেকে রাজশাহী বিভাগে পরিবহন ধর্মঘট থাকায় বুধবার থেকেই বিভিন্ন জেলা ও উপজেলা থেকে নেতাকর্মীরা রাজশাহীতে আসতে শুরু করেন। পথে পথে পুলিশি বাধার কারণে অন্তত ২০ থেকে ৩০ কিলোমিটার পর্যন্ত হেঁটে আসছেন। একে তো পরিবহন ধর্মঘট, তার ওপর নিজস্ব ও ভাড়া করা পরিবহনে রাজশাহী আসার পথে পুলিশি বাধার সম্মুখীন হতে হচ্ছে। ট্রাক, বাস, ট্রেনসহ ব্যক্তিগত গাড়ি নিয়ে তারা এসেছেন। মহানগরীর বিভিন্ন পয়েন্টে পুলিশ বিএনপি নেতাকর্মীদের দেখলেই গাড়ি থেকে নামিয়ে দিচ্ছে। ফলে দীর্ঘ পথ পায়ে হেঁটে রাজশাহী পৌঁছাতে হচ্ছে।
রাজশাহী মহানগর বিএনপির সিনিয়র নেতারা বলছেন, পথে পথে বাধা উপেক্ষা করে নেতাকর্মীরা সমাবেশে যোগ দিয়েছেন। সমাবেশস্থলে পৌঁছার আগেই রাজশাহী মহানগরীর প্রবেশদ্বারগুলোতে তাদের আটকে দিচ্ছে পুলিশ। মহাসড়ক দিয়ে একসঙ্গে পুলিশ আসতে দিচ্ছে না। তবে কোনো বাধাই নেতাকর্মীদের আটকে রাখতে পারেনি। দুইদিন আগেই সমাবেশে মানুষের স্রোত নামায় উজ্জীবিত নেতারা। শুক্রবার পর্যন্ত ঈদগাহ মাঠে অন্তত ২০ হাজার বিএনপি নেতাকর্মীর সমাগম ঘটেছে। বিভিন্ন হোটেল, নেতাকর্মীদের খালি করা বাসাবাড়ি কানায় কানায় ভরে গেছে। বিভিন্ন জেলা থেকে আসা নারী ও বৃদ্ধদের জন্য বিএনপি নেতারা বাসাবাড়ি, হোটেলসহ বিভিন্ন স্থানে থাকার ব্যবস্থা করা হয়েছে। অন্যরা সমাবেশস্থলেই থাকছেন।
শুক্রবার সরেজমিনে দেখা গেছে, সমাবেশকে কেন্দ্র করে আগে আসা নেতাকর্মীরা মাঠের মধ্যে সামিয়ানা টানিয়ে সেখানে পলিথিন, বস্তা ও ত্রিপল বিছিয়ে বিছানা করেছেন। সেখানেই করছেন রান্না। কেউ রান্না করেছেন সাদা ভাত, মাছ, মাংস আবার কেউ রান্না করছেন খিচুড়ি। পরে নিজেদের মধ্যে খাবার বিতরণ করছেন। বেশিভাগ মানুষ চিড়া, মুড়ি, কলা ও গুড়সহ শুকনো খাবার নিয়ে এসেছেন। আর দলীয় ব্যানার, ফেস্টুন ও পোস্টারে ছেয়ে গেছে সমাবেশস্থল। ক্ষণে ক্ষণে স্লোগান নিয়ে মাঠে ঢুকছেন বিভিন্ন জেলা থেকে আসা বিএনপি ও অঙ্গসংগঠনের নেতাকর্মীরা।
সেখানে কথা হয় জয়পুরহাটের ক্ষেতলাল উপজেলার যুবদল কর্মী আব্দুল রহিমের সঙ্গে। তিনি বাংলানিউজকে বলেন, সব কিছু বন্ধ থাকায় বুধবার দুপুরে সমাবেশস্থলে এসেছি। রাতে সামিয়ানা টানিয়ে থেকেছি। সমাবেশ সফল করে বাড়ি ফিরব।
নাটোরের নলডাঙ্গা থেকে এসেছেন খাইরুল ইসলাম। তিনি বলেন, পথে পথে দুর্ভোগ। নানা দুর্দশা সহ্য করে সমাবেশস্থলে এসেছি। এমন কষ্ট কখনো করতে হয়নি। সরকার সব বন্ধ করে দিয়েছে। আমরা ট্রাক ভাড়া করে এসেছি। এত কষ্ট করছি শুধু ভোটাধিকার ফেরত পাওয়ার জন্য।
বগুড়া সদর থেকে এসেছেন সুব্রত রায়। তিনি বিএনপির সমর্থক। সুব্রত বলেন, বগুড়া থেকে বাসে করে রাজশাহীতে আসতে বাধা দিয়েছে পুলিশ। এরপর অনেকদূর পথ ঘুরে এখানে এসেছি। কোনো বাধাই আটকে রাখতে পারবে না আমাদের। আমাদের অনেক নেতাকর্মী সাইকেল চালিয়ে ও হেঁটে এসেছে। আমরা রাতে এখানে থাকছি সমাবেশ সফল করার জন্য। রাতের ঘন কুয়াশা আর শীত উপেক্ষা করেও আমরা দেশকে মুক্ত করতে আন্দোলন সফলে রাতে থাকছি সমাবেশস্থলের পাশেই।
এদিকে, ময়মনসিংহ, খুলনা, রংপুর, বরিশাল বিভাগের মতো রাজশাহীতেও বিএনপির বিভাগীয় সমাবেশ শুরুর আগে থেকেই ধর্মঘট শুরু হয়েছে। বৃহস্পতিবার (১ ডিসেম্বর) ভোর ৬টা থেকে রাজশাহী থেকে দূরপাল্লা বা আন্তজেলা রুটের বাস চলাচল বন্ধ। এতে সড়কপথে রাজধানী ঢাকাসহ পুরো দেশের সঙ্গে রাজশাহীর যোগাযোগ ব্যবস্থা বিচ্ছিন্ন হয়ে পড়েছে। শুক্রবার (২ ডিসেম্বর) দুপুর সাড়ে ১২টা থেকে নতুন করে ধর্মঘটের ডাক দিয়েছেন সিএনজি ও থ্রি হুইলার চালকরা। আর এতে সীমাহীন দুর্ভোগে পড়েছেন সাধারণ মানুষ। গন্তব্যে যেতে ভোগান্তি পোহাতে হচ্ছে যাত্রীদের।
বিএনপি নেতাদের দাবি, রাজশাহী বিভাগীয় বিএনপির গণসমাবেশকে কেন্দ্র করে প্রশাসনের চাপেই পরিবহন মালিকরা এ ধর্মঘট ডেকেছেন। বাস ধর্মঘটের কারণে এমন ছোট ছোট যানবাহনে করে আসছিলেন নেতাকর্মীরা। আর সেই কারণে সিএনজিচালিত অটোরিকশা ও থ্রি হুইলার ধর্মঘট ডাকা হয়েছে।
রাজশাহী বিভাগীয় গণসমাবেশের সমন্বয়ক বিএনপি চেয়ারপারসনের উপদেষ্টা মিজানুর রহমান মিনু বলেন, এটি একটি প্রশাসনিক কৌশল। গণসমাবেশে বিএনপি নেতাকর্মীদের আসতে বাধা দেওয়ার জন্য সবকিছু বন্ধ করে দেওয়া হচ্ছে। কিন্তু এরপরও নেতাকর্মীরা কোনো না কোনোভাবে আসছেনই। শনিবারের সমাবেশে অন্তত ১৫ লাখ নেতাকর্মীর সমাগম হবে বলেও দাবি করেন বিএনপির এ নেতা।
এদিকে, গণসমাবেশকে সামনে রেখে বিএনপির নেতাকর্মীরা কোনো অপতৎপরতার চেষ্টা করলে তাদের পাল্টা জবাব দেওয়ার হুঁশিয়ারি দিয়েছে আওয়ামী লীগ। আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ও রাজশাহী সিটি মেয়র এএইচএম খায়রুজ্জামান লিটন বলেন, সরকার সমাবেশ করার অনুমতি দিয়েছে। কিন্তু যদি শুনি কোথাও কোনো গাড়ি ভেঙেছে, যানবাহনে আগুন দিয়েছে বা জনগণের মধ্যে অশান্তি তৈরি করেছে, তাহলে আইন প্রয়োগকারী সংস্থা কী করবে, সেটি তাদের ব্যাপার।