শীতকালে সাইবেরিয়াসহ বিভিন্ন অঞ্চলে তীব্র শীতের ফলে ঘটে তুষারপাত। তখন সেখানকার চারদিক বরফে আচ্ছন্ন হয়ে পড়ে। এসব অঞ্চলে পাখিদের টিকে থাকা তখন অসম্ভব হয়ে দাঁড়ায়।
এ সময় আমাদের মতো নাতিশীতোষ্ণ দেশ কিংবা অঞ্চলে হাজার হাজার মাইল পথ পরিযান করে বাংলাদেশের নানান জলাভূমিতে আসে নানা প্রজাতির পরিযায়ী হাঁসরা। সেসঙ্গে পাতিসরালি হাঁসসহ দেশি প্রজাতির নানান প্রজাতির হাঁস ছড়িয়ে ছিটিয়ে থাকা ছোট ছোট জলাশয়গুলো থেকে বড় জলাশয়গুলোতে এসে তখন একত্রিত হয়।
ঠিক এ সময়টাতে দেশের বিভিন্ন হাওর ও বিল এলাকার এক শ্রেণির কিছু লোভাতুর মানুষ এই পাখিগুলোকে জাল, বিষটোপ বা অন্য পদ্ধতিতে অবৈধভাবে ধরে, হত্যা করে এবং বিক্রি করে থাকে। এ পাখিগুলো প্রকৃতির শোভাবর্ধনকারী। এরা ভারসাম্য রক্ষা করে প্রকৃতির। এদের ধরা, শিকার করা, হত্যা করা এবং খাওয়া বাংলাদেশের প্রচলিত আইনে দণ্ডনীয় অপরাধ।
এমনি অপরাধের ঘটনা ঘটেছে সম্প্রতি মৌলভীবাজারের বড়লেখা উপজেলায়।
হাকালুকি হাওরে ১৭টি জলচর পাখি শিকারের ভাগবাটোয়ারার ঘটনায় এই বনপ্রহরীর সংশ্লিষ্টতার প্রমাণ পেয়েছে বন বিভাগ। ইতোমধ্যে তাকে প্রত্যাহার করা হয়েছে।
বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগ সূত্র জানায়, সম্প্রতি মৌলভীবাজারের বড়লেখার হাকালুকি হাওরে বিষটোপ দিয়ে জলচর জাতীয় পাখি শিকারের পর তা ভাগবাটোয়ারায় জড়িত ছিলেন বনপ্রহরী মোতাহার হোসেন।
বিষয়টি জানাজানি হলে সোমবার (১৬ জানুয়ারি) একটি তদন্ত কমিটি গঠন করে বন বিভাগ।
এ কমিটির আহ্বায়ক এবং বন্যপ্রাণী ব্যবস্থাপনা ও প্রকৃতি সংরক্ষণ বিভাগের (মৌলভীবাজার) সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র।
তিনি সরেজমিন ঘটনাস্থল পরিদর্শন করে এর ঘটনার সত্যতা খুঁজে পান।
হাকালুকি হাওরের একটি বিল থেকে তালিমপুর ইউপির মুর্শিবাদকুরা গ্রামের আলাউদ্দিনের ছেলে হোসেন আহমদ বিষটোপ দিয়ে প্রায় অর্ধশতাধিক পাতিসরালি হাঁসসহ অন্যান্য হাঁস শিকার করেন।
শনিবার (১৪ জানুয়ারি) সকালে তিনি পাখিগুলো বস্তায় ভরে স্থানীয় কাননগোবাজারে বিক্রির জন্য নিয়ে আসেন। খবর পেয়ে হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা বনপ্রহরী মোতাহার হোসেন পাখিসহ হোসেনকে আটক করে স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যান ও মেম্বারের কাছে নিয়ে যান। পরে তাদের সামনে ‘ভবিষ্যতে এ ধরনের গর্হিত কাজ করবেন না’ মর্মে পাখিশিকারী হোসেনের কাছ থেকে মুচলেকা নেন মোতাহার। পরে তাকে ছেড়ে দেওয়া হয়।
স্থানীয় আরেকটি সূত্র জানায়, সম্প্রতি পাখি শিকারিকে ছেড়ে দেওয়ার পর প্রায় অর্ধশতাধিক হাঁস পাখি স্থানীয় জনপ্রতিনিধি ও প্রভাবশালীরা ‘ভাগবাটোয়ারা’ করে নেন। আর পাখিশিকারি হোসেনের কাছ থেকে লিখিত মুচলেকায় তিনটি পাখির কথা উল্লেখ করা হয়। মূলত শিকারিকে বাঁচাতে অর্ধশতাধিক পাখি শিকারের প্রকৃত তথ্য গোপন করেন ওই বনপ্রহরী। এর সঙ্গে স্থানীয় জনপ্রতিনিধিরাও জড়িত ছিলেন।
অভিযোগ রয়েছে, বনপ্রহরী মোতাহার প্রায়ই পাখি শিকারে জড়িত কাউকে আটক করলে উৎকোচ নিয়ে ছেড়ে দেন।
বৃহস্পতিবার (১৯ জানুয়ারি) দুপুরে বাংলানিউজকে সেই তদন্ত কমিটির আহ্বায়ক এবং সহকারী বন সংরক্ষক (এসিএফ) শ্যামল কুমার মিত্র বলেন, হাকালুকি হাওরে পাখি শিকার করে ভাগবাটোয়ারার ঘটনাটি তদন্তে প্রাথমিকভাবে আমরা প্রমাণ পেয়েছি।
বিষটোপ দিয়ে শিকার করা বিভিন্ন প্রজাতির হাঁস।
হাকালুকি বিটের দায়িত্বে থাকা বনপ্রহরী মোতাহার হোসেনের সংশ্লিষ্টতাও মিলেছে। এটা বড়লেখা উপজেলার তালিমপুর ইউনিয়ন। তিনি হাতেনাতে ধরা পড়েছেন। আমার তদন্ত প্রতিবেদনও হয়ে গেছে। আমি শিগগিরই প্রতিবেদনটি ওয়াইল্ডলাইফ ডিভিশনের ডিএফও এর (বন্যপ্রাণী বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা) কাছে জমা দেবো। এরপর থেকে তার প্রাতিষ্ঠানিক শাস্তি শুরু হয়ে যাবে। তবে ইতোমধ্যে তাকে প্রত্যাহার করে নিয়েছে বন বিভাগ।
অপরাধের সংশ্লিষ্টতার বিষয়ে তিনি আরও বলেন, স্থানীয় ইউপি চেয়ারম্যানসহ বিভিন্ন মানুষের সঙ্গে কথা বলে জানতে পেরেছি মোট ১৭টা জলচর পাখি বিষটোপ দিয়ে হত্যা করেছিলেন স্থানীয় পাখিশিকারি হোসেন।
একজন আমাকে বলেছেন, তিনি ১৭টা পাখি ভাগবাটোয়ারা করতে দেখেছেন। তাছাড়া সেই পাখিশিকারীর কাছ থেকে বনপ্রহরী মোতাহার মুচলেকা নেওয়ার কে? তার তো এ বিষয়ে মুচলেকা নেওয়ার কোনো ক্ষমতাই নেই।