ঢাকা , শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
Logo সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের রফিনগর গ্রামের সাজ্জাতুলের বাড়িঘরে হামলা,ভাংচুর লুটপাঠসহ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ভাংচুরের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন Logo বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত -নিহতদের স্মরণে দোয়ারাবাজারে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত Logo অন্তবর্তীকালীন সরকার পতনের ষড়যন্ত্র গোপন বৈঠকে থাকা ছাত্রলীগের ৩৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি Logo শান্তিগঞ্জে বিনামূল্যে গরু বিতরণের লক্ষ্যে অবহিতকরণ সভা ও প্রশিক্ষণ Logo দোয়ারাবাজারে সরকারি গাছ কর্তন।। জব্দ করলো প্রশাসন Logo শান্তিগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা  Logo ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের স্মরণে তাহিরপুরে’স্মরণ সভা’ Logo ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের স্মরণে শান্তিগঞ্জে ‘স্মরণ সভা’ Logo চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ বাম্পার ফলনে শান্তিগঞ্জের কৃষকের মুখে হাসি Logo জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-জনতার গণঅদ্ভুত্থানে আহত ও শহীদদের স্মরণে ছাতকে স্মরণ সভা

কুষ্টিয়ার প্রতিবাদী যে ফুলপরী সাহসিকতার উদাহরণ

 কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন একজন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে চান না। যা সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করেছে।‘’আমি যেটা করেছি, সেটা আমার কর্তব্য মনে করেই করেছি। কেন আমার সাথে এমন অন্যায় হলো, আমি তো কোনো অপরাধ করি নাই। তাই কোনো অন্যায়, অবিচারও আমি মুখ বুজে সহ্য করার কথা ভাবি নাই। আমি জানি আমি যেরকম সাধারণ, ওরাও সেরকম সাধারণ। আমি নতুন হতে পারি, কিন্তু ওনাদের দেখে কেন ভয় পাবো?’’বলছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন।সম্প্রতি তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটি আবাসিক হলে ওঠায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হন। সেই ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছে।এই বছর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন ফুলপরী খাতুন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করার মাত্র ১০দিনের মাথায় ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি।ফেব্রুয়ারি মাসের আট তারিখে তার ক্লাস শুরু হয়েছিল। বাসা দূরে হওয়ায় এক আবাসিক শিক্ষার্থীর কক্ষে থেকেছিলেন ফুলপরী। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের না জানিয়ে হলে ওঠার অভিযোগ তুলে গত ১১ই ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করে।তার অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা তার ওপর নির্যাতন করে। সেই সময় বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা, গালাগালি করা এবং কাউকে জানালে মারধর করারও হুমকি দেয়া হয়। এমনকি সে মারা গেলে হলের কেউ দায়ী থাকবে না, এমন লিখিত নেয়া হয় ফুলপরীর কাছ থেকে।এই ঘটনার ব্যাপারে সানজিদা চৌধুরী মিডিয়ার কাছে কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।ফুলপরী খাতুনের এই অভিযোগ নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়। হাইকোর্টে রিট হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্তে নির্যাতনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচজনের হলের সিট বাতিল করে দেয়া হয়েছে।ফুলপরী খাতুন বলছিলেন, ওই ঘটনার পর বাসায় ফিরে তিনি পরিবারের সদস্যদের সব জানান।‘’আমি যখন বাসায় আসি, আমার আব্বু, ভাই-বোনদের সব খুলে বলি। তারা সবাই বলেছেন, এর একটা প্রতিবাদ তো করতেই হবে। তারা হয়তো আমাকে ঘরের মধ্যেই চুপ করিয়ে রাখতে পারতো। কিন্তু আমার বাবা-ভাই সেটা করেননি।‘’ফুলপরী খাতুনের বাবা কুষ্টিয়ায় ভ্যান চালান। চার ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।বাংলাদেশের আরও অনেক শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরেও অনেকে অভিযোগ করতে চান না।ফুলপরী খাতুনের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার তিনদিন আগে ৮ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে শিবিরের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে চারজন ছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।সেই ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলেও বিবিসি বাংলার কাছে আলাপের সময় ভয়ে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি ভুক্তভোগীরা। কোন মামলাও হয়নি।বাংলাদেশের আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হয়েও ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে চান না। ফুলপরী খাতুন কেন এগিয়ে এলেন?এমন প্রশ্নের জবাবে ফুলপরী খাতুন বলছেন, ‘’এখানে সাহসিকতা দেখানোর কোন বিষয় আমি ভাবিনি। আমার নিজের ভেতর থেকেই এটা হয়েছে। ওনারা যাই হোক না কেন, ওনাদের দেখে আমি কেন ভয় পাবো? আমার সাথে অন্যায় হয়েছে, আমি তো প্রতিবাদ করবোই। সেজন্যই আমি প্রতিবাদ করেছি। কেন করবো না?‘’ফুলপরী খাতুন বলছিলেন, সেদিন রাতে তাকে যেরকম ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, এরকম তার জীবনে আর কখনো হয়নি। একসময় মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো মারাই যাবেন।’আমার তো মনে হয়েছিল, আমি মারাই যাচ্ছি। তখন ভাবছিলাম, আমি মরে গেলে তো মরে যাবো, কিন্তু আমার বাবা-মার কতো কষ্ট হবে। এরকমভাবে যে বিনা কারণে কাউকে নির্যাতন করে, সেটা কখনো ভাবতে পারিনি। এটা কি একটা স্বাধীন দেশ?’’ বলছিলেন ফুলপরী খাতুন।ফুলপরী জানান, এরপর তদন্ত কমিটি যখন ঘটনা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে তাকে ডেকেছিলেন, সানজিদা আক্তারসহ অন্যদের সামনা-সামনি করা হলে সেই সময় তারা তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ফুলপরী মনে করেন, তাদের প্রাপ্য সাজা তাদের পাওয়া উচিত।’ওনারা যে শাস্তি প্রাপ্য, যা অন্যায় করেছেন, তার শাস্তি তো তারা পাবেন। এখানে আমার আর মনে করার কিছু নেই। আমি তো চাই, যাদের মনুষত্ববোধ নাই, তারা ভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষা পাওয়ার যোগ্য না।‘’’সেদিন যখন তারা আমার ওপর নির্যাতন করছিল, আমিও তাদের কতো হাতেপায়ে ধরেছি। তারা তো আমাকে মেরেই ফেলত, যদি তাদের একটা কথাও আমি না শুনতাম। ওদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে মেরে ফেলা। তারা কাগজে লিখে নিয়েছিল, আমি যদি মরেও যাই, এই হলের কেউ দায়ী থাকবে না,’’ বলছেন ফুলপরী খাতুন।এই ঘটনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তাকে ফোন করে তার সাহসিকতার জন্য অভিবাদন জানিয়েছেন বলে জানান ফুলপরী। ঢাকায় ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, ফুলপরী ন্যায়বিচারের প্রতীক, ছাত্রলীগ ফুলপরীর পক্ষে রয়েছে।এখন তদন্ত কার্যক্রম চললেও সবমিলিয়ে মানসিক চাপের মধ্যেই রয়েছেন ফুলপরী খাতুন।তিনি বলছেন, ‘’টেনশন থাকে না বলেন? এতোবড় একটা ঘটনা, মানসিকভাবে তো আমি চাপের মধ্যেই আছি। ‘’তবে তিনি আশা করছেন, খুব তাড়াতাড়ি এসব ঘটনা মিটে যাবে এবং আবার স্বাভাবিকভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করতে পারবেন।ফুলপরী খাতুনের এই ঘটনা প্রসঙ্গে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক শাহানা হুদা রঞ্জনা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বাংলাদেশে আমরা তো আসলে খুব বেশি প্রতিবাদ দেখতে পাই না। ফুলপরী যা করেছে, এটাই আসলে হয়তো সবসময় উচিত। কিন্তু সবসময় সেটা না হওয়ার কারণেই ফুলপরী একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়িয়েছে।তিনি বলছেন, ‘’দেখুন সে কথা বলার পর আরও চারজন মেয়ে অভিযোগ দিয়েছে যে, তাদের সাথেও এরকম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সে দেখিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ দিলে বিচার পাওয়া যায়। সেও পরিষ্কার করে দিয়েছে, আমি বিচার চাই, ন্যায্য বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি থামবো না।‘’শাহানা হুদা রঞ্জনা বলছেন, ‘’গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে অন্য সবার মতো বিপদ আপদ-এতো চিন্তা না করে যে প্রতিবাদী হয়েছে, সে একটা উদাহরণ স্থাপন করেছে। সবসময় এটাই হওয়া উচিত, কিন্তু আসলে হয় না, সেই কারণেই ফুলপরী একটা দৃষ্টান্ত।‘’

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

Janasarthe 24

আপনাদের আশে পাশে ঘটে যাওয়া প্রতি মুহুর্তের খবর দিয়ে আমাদের সহযোগীতা করুন। আমরা আমাদের অনলাইনে তা প্রকাশ করে কৃতজ্ঞ হবো। আমাদের প্রতি মুহুর্তের খবর জানতে আমাদের সাথে থাকুন
জনপ্রিয় সংবাদ

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের রফিনগর গ্রামের সাজ্জাতুলের বাড়িঘরে হামলা,ভাংচুর লুটপাঠসহ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ভাংচুরের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন

কুষ্টিয়ার প্রতিবাদী যে ফুলপরী সাহসিকতার উদাহরণ

আপডেট সময় ০৭:৩৪:১১ পূর্বাহ্ন, বুধবার, ১ মার্চ ২০২৩

 কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ে এরকম নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর প্রতিবাদী হয়ে উঠেছেন একজন শিক্ষার্থী, বাংলাদেশের শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পর ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে চান না। যা সারাদেশে আলোড়ন তৈরি করেছে।‘’আমি যেটা করেছি, সেটা আমার কর্তব্য মনে করেই করেছি। কেন আমার সাথে এমন অন্যায় হলো, আমি তো কোনো অপরাধ করি নাই। তাই কোনো অন্যায়, অবিচারও আমি মুখ বুজে সহ্য করার কথা ভাবি নাই। আমি জানি আমি যেরকম সাধারণ, ওরাও সেরকম সাধারণ। আমি নতুন হতে পারি, কিন্তু ওনাদের দেখে কেন ভয় পাবো?’’বলছিলেন কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম বর্ষের শিক্ষার্থী ফুলপরী খাতুন।সম্প্রতি তিনি এই বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তি হওয়ার পর একটি আবাসিক হলে ওঠায় ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হন। সেই ঘটনা সারা দেশে আলোড়ন তৈরি করেছে।এই বছর কুষ্টিয়া ইসলামী বিশ্ববিদ্যালয়ের স্নাতক প্রথম বর্ষে ভর্তি হয়েছেন ফুলপরী খাতুন। কিন্তু বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করার মাত্র ১০দিনের মাথায় ভয়াবহ এক অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হন তিনি।ফেব্রুয়ারি মাসের আট তারিখে তার ক্লাস শুরু হয়েছিল। বাসা দূরে হওয়ায় এক আবাসিক শিক্ষার্থীর কক্ষে থেকেছিলেন ফুলপরী। কিন্তু ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীদের না জানিয়ে হলে ওঠার অভিযোগ তুলে গত ১১ই ফেব্রুয়ারি রাতে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা তাকে সাড়ে চার ঘণ্টা আটকে রেখে নির্যাতন করে।তার অভিযোগ, বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীর নেতৃত্বে তার অনুসারীরা তার ওপর নির্যাতন করে। সেই সময় বিবস্ত্র করে ভিডিও ধারণ করা, গালাগালি করা এবং কাউকে জানালে মারধর করারও হুমকি দেয়া হয়। এমনকি সে মারা গেলে হলের কেউ দায়ী থাকবে না, এমন লিখিত নেয়া হয় ফুলপরীর কাছ থেকে।এই ঘটনার ব্যাপারে সানজিদা চৌধুরী মিডিয়ার কাছে কোনো মন্তব্য করেননি। কিন্তু তদন্ত কমিটির কাছে সাক্ষ্য দেওয়ার সময় তিনি তার বিরুদ্ধে আনা অভিযোগ অস্বীকার করেছেন।ফুলপরী খাতুনের এই অভিযোগ নিয়ে সারা দেশে আলোড়ন তৈরি হয়। হাইকোর্টে রিট হওয়ার পর বিশ্ববিদ্যালয় ও প্রশাসনের পক্ষ থেকে একাধিক তদন্ত কমিটি গঠন করা হয়েছে। ইতোমধ্যে তদন্তে নির্যাতনের ঘটনায় দোষী সাব্যস্ত হওয়ায় বিশ্ববিদ্যালয় ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি সানজিদা চৌধুরীসহ পাঁচজনের হলের সিট বাতিল করে দেয়া হয়েছে।ফুলপরী খাতুন বলছিলেন, ওই ঘটনার পর বাসায় ফিরে তিনি পরিবারের সদস্যদের সব জানান।‘’আমি যখন বাসায় আসি, আমার আব্বু, ভাই-বোনদের সব খুলে বলি। তারা সবাই বলেছেন, এর একটা প্রতিবাদ তো করতেই হবে। তারা হয়তো আমাকে ঘরের মধ্যেই চুপ করিয়ে রাখতে পারতো। কিন্তু আমার বাবা-ভাই সেটা করেননি।‘’ফুলপরী খাতুনের বাবা কুষ্টিয়ায় ভ্যান চালান। চার ভাইবোনের মধ্যে বড় ভাই রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেছেন। বোন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন।বাংলাদেশের আরও অনেক শিক্ষাঙ্গনে ক্ষমতাসীন দলের নেতা-কর্মীদের নির্যাতনের শিকার হওয়ার পরেও অনেকে অভিযোগ করতে চান না।ফুলপরী খাতুনের ওপর নির্যাতনের অভিযোগ ওঠার তিনদিন আগে ৮ই ফেব্রুয়ারি চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজের প্রধান ছাত্রাবাসে শিবিরের সাথে জড়িত থাকার অভিযোগ তুলে চারজন ছাত্রকে পিটিয়ে গুরুতর জখম করে ছাত্রলীগের নেতা-কর্মীরা।সেই ঘটনায় হাসপাতালে ভর্তি হতে বাধ্য হলেও বিবিসি বাংলার কাছে আলাপের সময় ভয়ে নিজেদের নাম প্রকাশ করতে চাননি ভুক্তভোগীরা। কোন মামলাও হয়নি।বাংলাদেশের আরও অনেক শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানে এভাবে ক্ষমতাসীন দলের ছাত্র সংগঠনের নেতা-কর্মীদের বিরুদ্ধে নির্যাতনের শিকার হয়েও ভুক্তভোগীরা মুখ খুলতে চান না। ফুলপরী খাতুন কেন এগিয়ে এলেন?এমন প্রশ্নের জবাবে ফুলপরী খাতুন বলছেন, ‘’এখানে সাহসিকতা দেখানোর কোন বিষয় আমি ভাবিনি। আমার নিজের ভেতর থেকেই এটা হয়েছে। ওনারা যাই হোক না কেন, ওনাদের দেখে আমি কেন ভয় পাবো? আমার সাথে অন্যায় হয়েছে, আমি তো প্রতিবাদ করবোই। সেজন্যই আমি প্রতিবাদ করেছি। কেন করবো না?‘’ফুলপরী খাতুন বলছিলেন, সেদিন রাতে তাকে যেরকম ঘটনার মুখোমুখি হয়েছে, এরকম তার জীবনে আর কখনো হয়নি। একসময় মনে হয়েছিল, তিনি হয়তো মারাই যাবেন।’আমার তো মনে হয়েছিল, আমি মারাই যাচ্ছি। তখন ভাবছিলাম, আমি মরে গেলে তো মরে যাবো, কিন্তু আমার বাবা-মার কতো কষ্ট হবে। এরকমভাবে যে বিনা কারণে কাউকে নির্যাতন করে, সেটা কখনো ভাবতে পারিনি। এটা কি একটা স্বাধীন দেশ?’’ বলছিলেন ফুলপরী খাতুন।ফুলপরী জানান, এরপর তদন্ত কমিটি যখন ঘটনা সম্পর্কে সাক্ষ্য দিতে তাকে ডেকেছিলেন, সানজিদা আক্তারসহ অন্যদের সামনা-সামনি করা হলে সেই সময় তারা তাদেরকে ক্ষমা করে দেয়ার কথা বলেছিলেন। কিন্তু ফুলপরী মনে করেন, তাদের প্রাপ্য সাজা তাদের পাওয়া উচিত।’ওনারা যে শাস্তি প্রাপ্য, যা অন্যায় করেছেন, তার শাস্তি তো তারা পাবেন। এখানে আমার আর মনে করার কিছু নেই। আমি তো চাই, যাদের মনুষত্ববোধ নাই, তারা ভার্সিটিতে উচ্চ শিক্ষা পাওয়ার যোগ্য না।‘’’সেদিন যখন তারা আমার ওপর নির্যাতন করছিল, আমিও তাদের কতো হাতেপায়ে ধরেছি। তারা তো আমাকে মেরেই ফেলত, যদি তাদের একটা কথাও আমি না শুনতাম। ওদের উদ্দেশ্য ছিল আমাকে মেরে ফেলা। তারা কাগজে লিখে নিয়েছিল, আমি যদি মরেও যাই, এই হলের কেউ দায়ী থাকবে না,’’ বলছেন ফুলপরী খাতুন।এই ঘটনার পর ছাত্রলীগের কেন্দ্রীয় কমিটির সভাপতি সাদ্দাম হোসেন তাকে ফোন করে তার সাহসিকতার জন্য অভিবাদন জানিয়েছেন বলে জানান ফুলপরী। ঢাকায় ছাত্রলীগের একটি অনুষ্ঠানে সাদ্দাম হোসেন বলেছেন, ফুলপরী ন্যায়বিচারের প্রতীক, ছাত্রলীগ ফুলপরীর পক্ষে রয়েছে।এখন তদন্ত কার্যক্রম চললেও সবমিলিয়ে মানসিক চাপের মধ্যেই রয়েছেন ফুলপরী খাতুন।তিনি বলছেন, ‘’টেনশন থাকে না বলেন? এতোবড় একটা ঘটনা, মানসিকভাবে তো আমি চাপের মধ্যেই আছি। ‘’তবে তিনি আশা করছেন, খুব তাড়াতাড়ি এসব ঘটনা মিটে যাবে এবং আবার স্বাভাবিকভাবে তিনি বিশ্ববিদ্যালয় জীবন শুরু করতে পারবেন।ফুলপরী খাতুনের এই ঘটনা প্রসঙ্গে মানুষের জন্য ফাউন্ডেশনের জ্যেষ্ঠ সমন্বয়ক শাহানা হুদা রঞ্জনা বিবিসি বাংলাকে বলছেন, বাংলাদেশে আমরা তো আসলে খুব বেশি প্রতিবাদ দেখতে পাই না। ফুলপরী যা করেছে, এটাই আসলে হয়তো সবসময় উচিত। কিন্তু সবসময় সেটা না হওয়ার কারণেই ফুলপরী একটা দৃষ্টান্ত হয়ে দাড়িয়েছে।তিনি বলছেন, ‘’দেখুন সে কথা বলার পর আরও চারজন মেয়ে অভিযোগ দিয়েছে যে, তাদের সাথেও এরকম নির্যাতনের ঘটনা ঘটেছে। সে দেখিয়ে দিয়েছে, অভিযোগ দিলে বিচার পাওয়া যায়। সেও পরিষ্কার করে দিয়েছে, আমি বিচার চাই, ন্যায্য বিচার না পাওয়া পর্যন্ত আমি থামবো না।‘’শাহানা হুদা রঞ্জনা বলছেন, ‘’গ্রাম থেকে উঠে আসা একটা মেয়ে অন্য সবার মতো বিপদ আপদ-এতো চিন্তা না করে যে প্রতিবাদী হয়েছে, সে একটা উদাহরণ স্থাপন করেছে। সবসময় এটাই হওয়া উচিত, কিন্তু আসলে হয় না, সেই কারণেই ফুলপরী একটা দৃষ্টান্ত।‘’