দেশের সব জেলাতেই ছড়িয়েছে ডেঙ্গু। আক্রান্তের সংখ্যা ছাড়িয়েছে লাখ। স্বাস্থ্য অধিদপ্তরের তথ্যমতে, পূর্বের তুলনায় ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে ঢাকায় হাসপাতালে ভর্তি হওয়া রোগীর সংখ্যা কমেছে। তবে ঢাকার বাইরে ডেঙ্গুরোগী বাড়ছে আশঙ্কাজনক হারে। অন্যদিকে, আনুপাতিক হারে বেড়েছে মৃত্যু। এরই মধ্যে মৃত্যু ছাড়িয়েছে ৫০০। এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্ত ও মৃত্যুর যে সংখ্যা, তা ইতিহাসে সর্বোচ্চ।
এমন পরিস্থিতিতে যেন তিল ধারণের ঠাঁই নেই হাসপাতালগুলোতে। বাড়তি চাপের কারণে ডেঙ্গুরোগীরা যেমন দুর্ভোগ পোহাচ্ছেন হাসপাতালে, তেমন সেবা দিতে হিমশিম খাচ্ছেন চিকিৎসক, নার্স ও স্বাস্থ্যকর্মীরা।
বুধবার (২৩ আগস্ট) সরেজমিনে শিশু হাসপাতাল ঘুরে দেখা গেছে, সকাল থেকেই জরুরি বিভাগে রোগীদের ভিড়। এখানে আসা প্রায় সব শিশুরই রয়েছে জ্বর। ডেঙ্গু ডেডিকেটেড ওয়ার্ডগুলোতে দেখা গেছে, কোনো বেড ফাঁকা নেই। হঠাৎ হঠাৎ কোনো বেড খালি হলে মুহূর্তের মধ্যেই সেগুলো পূরণ হচ্ছে অপেক্ষমাণ রোগীদের দিয়ে।
হাসপাতালের তথ্যে জানা যায়, গত ২৪ ঘণ্টায় হাসপাতালে নতুন ভর্তি হয়েছে ১৮ জন শিশু। বর্তমানে হাসপাতালে ডেঙ্গু আক্রান্ত শিশু ভর্তি আছে ১০৯ জন। জানুয়ারি থেকে ২৩ আগস্ট পর্যন্ত ডেঙ্গু আক্রান্ত হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে ৯২৮ জন। তাদের মধ্যে আইসিইউতে ভর্তি হয়েছিল ৯ জন, মারা গেছে ১৩ জন।
জরুরি বিভাগে দেখা যায় ৫ বছরের মুশফিককে। প্রায় ২৩ দিন ধরে ভুগছে জ্বরে। তার বাবা মাসুদ জাগো নিউজকে জানান, এ মাসের ১ তারিখেই হাসপাতালে ভর্তি হয়েছিল শিশুটি। ১৫ দিন ভর্তি থেকে চিকিৎসা নিয়েছে। পরে চিকিৎসকরা হাসপাতাল থেকে রিলিজ দেন। তবে এরপরও জ্বর আসা-যাওয়া করছে। বমিও হচ্ছে বারবার। এ অবস্থায় আবার ডাক্তারের কাছে এসেছেন।
তার মতো লাইনে দাঁড়িয়ে থাকা অন্তত ১০ জনের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, প্রতিটি শিশুরই জ্বর বা ঠান্ডাজনিত সমস্যা।
জরুরি বিভাগে দায়িত্বরত চিকিৎসকরা জানান, বেশিরভাগ শিশুরই জ্বর ও ঠান্ডাজনিত সমস্যা। জ্বর নিয়ে আসলে ডেঙ্গু টেস্ট দেওয়া হয়। ভর্তি প্রয়োজন হলে সিট থাকলে ভর্তি দেওয়া হয়। আর সিট না থাকলে পরামর্শ দেওয়া হয় অন্য হাসপাতালে যাওয়ার।
৪ বছর বয়সী শাফায়াত মাহমুদ রোহান। জ্বরে ভুগছে ১ মাস ধরে। তার মা জান্নাতুল ফেরদৌস জানান, কুমিল্লা থেকে এখানে চিকিৎসার জন্য এসেছেন। এতদিন জ্বর আসা-যাওয়ার মাঝে থাকলেও গত ৭ দিন ধরে জ্বর অনেক বেশি। ডেঙ্গু পরীক্ষায় নেগেটিভ আসলেও প্লাটিলেট কমে যাচ্ছে শিশুর। চিকিৎসকরা জানিয়েছেন, তার যেসব লক্ষণ রয়েছে সেগুলো ডেঙ্গুর। তবে পরীক্ষায় তার ডেঙ্গু শনাক্ত হয়নি।
কর্তব্যরত চিকিৎসকদের কাছে শিশুদের দীর্ঘদিন জ্বরে ভোগার কারণ জানতে চাইলে তারা জানান, এসময়ে ডেঙ্গু ছাড়াও ভাইরাল জ্বরে আক্রান্ত হচ্ছে শিশুরা। এছাড়া অনেক শিশুর নিউমোনিয়াসহ অন্যান্য রোগে আক্রান্ত হয়েও জ্বরে ভুগছে।
বাদ যাচ্ছে না সদ্যজাত বা এক-দুই মাসের শিশুরাও। দেড় মাস বয়সী শিশু ফাহাদ। চারদিন ধরে অসুস্থ হয়ে হাসপাতালে ভর্তি হয়েছে। প্রথমে ডেঙ্গু শনাক্ত হয়। এরপর থেকেই হাসপাতালে ভর্তি।
শরীয়তপুরের জাজিরা থেকে শিশু হাসপাতালে চিকিৎসার জন্য আয়েশাকে নিয়ে এসেছেন তার মা ফাতেমা। শিশুটির বয়স মাত্র ১০ দিন। জন্মের তৃতীয় দিন থেকেই জ্বরে আক্রান্ত। পরীক্ষার পর শনাক্ত হয়েছে ডেঙ্গু। তবে কয়েক দিন ধরে জ্বর নেই। অনেকটা সুস্থ হয়ে উঠেছে সে।
শিশুদের চিকিৎসা দেওয়ার ক্ষেত্রে অন্যতম বিড়ম্বনা হচ্ছে ক্যানোলা লাগানো ও তা ঠিক রাখা। শিশুদের মায়েদের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, শিশুদের স্যালাইন, ইনজেকশন দেওয়ার জন্য ক্যানোলা লাগানো হলে তাদের নড়াচড়ায় ক্যানোলা নষ্ট হয়ে যায়। আবার নতুন করে লাগাতে গিয়ে কয়েকবার চেষ্টা করা হয়। অনেক সময় দুই-তিনবার চেষ্টা করেও ক্যানোলা লাগাতে পারেন না। বার বার ক্যানোলা খুলে যাওয়ায় কষ্ট পেতে হয় শিশুদের।
অন্য কাজে ঢাকায় এসে ডেঙ্গুতে আক্রান্ত হয়ে শিশু হাসপাতালে ভর্তি হতে হয়েছে ১৩ মাস বয়সী মোস্তাকিম বিল্লাহকে। ৬ দিন ধরে হাসপাতালে ভর্তি সে। জ্বর এখন অনেকটা কম। মোস্তাকিমকে দেখা যায়, চিকিৎসক বা নার্সদের দেখলেই কান্না করছে ভয়ে।
তার মায়ের সঙ্গে কথা বলে জানা যায়, তার শরীরে এরই মধ্যে কয়েক দফায় ক্যানোলা করা হয়েছে। বাচ্চার নড়াচড়ায় খুলে যায় ক্যানোলা। এতে বার বার ক্যানোলা লাগানোর ব্যথায় আতঙ্ক তৈরি হয়েছে তার মধ্যে। এখন নার্সদের দেখলেই কান্না করে।
কর্তব্যরত নার্সরা জানান, শিশুদের ভেইন খুঁজে পেতে অনেক সময় কষ্ট হয়ে যায়। এতে ক্যানোলা দিতে সমস্যা হয়। আবার অনেক শিশু নড়াচড়ার কারণেও ক্যানোলা দিতে সমস্যা হয়। শিশু বলেই এ সমস্যা। মায়েদের একটু ধৈর্য ধরতে হবে।
শিশু হাসপাতালের ডেঙ্গু বিভাগের ইনচার্জ ডা. ফারহানা আহমেদ জাগো নিউজকে জানান, অন্যান্য বছরের তুলনায় এ বছর ডেঙ্গু আক্রান্তের সংখ্যা অনেক বেশি। এ কারণে গতবারের চেয়ে এবার দ্বিগুণ বেডের ব্যবস্থা করা লেগেছে। এখন ক্রিটিক্যাল রোগীর সংখ্যাও বেশি। অনেক রোগী আছে যারা দ্বিতীয়বার কিংবা তৃতীয়বারের মতো আক্রান্ত হয়েছে। তাদের ঝুঁকি অনেক বেশি। যেসব শিশুর অন্য কোনো শারীরিক জটিলতা রয়েছে, তাদের নিয়ে ঝুঁকিটা আরও বেশি। এ বছর ১ বছরের কম বয়সী বাচ্চা অনেক বেশি পাওয়া যাচ্ছে। এছাড়া এক-দুই মাসের বাচ্চাও পাচ্ছি এ রোগ নিয়ে।
তিনি জানান, এবার অনেকে আসছে বুকে ব্যাথা নিয়ে। হার্টের সমস্যা, ব্রেইনের সমস্যাও হচ্ছে এ রোগে। এছাড়া রক্তক্ষরণ নিয়েও ভর্তি হচ্ছে শিশুরা।