ফুটবলের কথা উঠলে যে নামটি সবচেয়ে বেশি উচ্চারিত হয়, তা হলো পেলে। ফুটবল তো বটেই, ক্রীড়াজগতের সবচেয়ে উজ্জ্বল নক্ষত্র ব্রাজিলিয়ান এই কিংবদন্তি। ছোট বেলায় তার লড়াই ছিল দারিদ্র্যতার সঙ্গে। তবে ফুটবল প্রতিভা দিয়ে বিশ্বের বুকে আলো ছড়িয়ে ছড়িয়েছেন ফুটবলের এই রাজা। ফুটবল বিশ্বমঞ্চে রথী-মহারথীদের ভিড়ে সর্বকালের সেরা হিসেবে তাকেই বিবেচনা করা হয়। গেল বছর পরপারে পাড়ি জমানো এই ফুটবল কিংবদন্তির ৮৩তম জন্মদিন আজ।
ব্রাজিলে ফুটবল খেলাটি যেন প্রতিটি শিশু-কিশোরের ধ্যান-জ্ঞান। ফুটবলপাগল সেই দেশটির হয়ে ১ হাজার ১৮৪ প্রতিযোগিতামূলক ম্যাচ খেলেছেন পেলে। করেছেন ১ হাজার ১২৪ গোল। মূলত তার হাত ধরেই অনন্য উচ্চতায় পৌঁছে ফুটবল। সঙ্গত কারণেই পেয়েছেন কিং অব ফুটবলের তকমা। এই প্রজন্মের প্রত্যেকেই তার মতো হতে চায়। এতেই তার শ্রেষ্ঠত্ব প্রমাণিত হয়।
তবে এই শ্রেষ্ঠত্ব পেলের কাছে এমনি এমনিই ধরা দেয়নি। ‘ফুটবল রাজা’ হতে পোড়াতে হয়েছে অনেক কাঠখড়। ১৯৪০ সালের ২৩ অক্টোবর সাও পাওলো শহরের ট্রেস কোরাকয়েসে জন্ম নেন তিনি। ওই সময় সেই এলাকার অর্থনৈতিক অবস্থা ও জীবনযাত্রার মান ভয়ংকর ছিল। তখনকার ব্রাজিলীয় সমাজের পিছিয়ে থাকা জনগোষ্ঠী সেখানে বসবাস করত।
বাল্যকাল থেকেই ফুটবল সম্রাটকে প্রচুর পরিশ্রম করতে হয়েছে। যথেষ্ট কষ্ট পোহাতে হয়েছে। তবুও ফুটবল আঁকড়ে ছিলেন। একটি ফুটবল ছিল নিত্যসঙ্গী। রক্তে মিশে ছিল ফুটবল। খেলাটির প্রতি তার ভালোবাসা থাকাটাও স্বাভাবিক। কারণ, বাবা ছিলেন তখনকার শীর্ষস্থানীয় ক্লাব ‘ফ্লুমিনেসের’ ফুটবলার। তার নাম জোয়াও রামোস দ্য নাসিমেন্তো। যিনি ‘ডনডিনহো’ নামেই বেশি পরিচিত। পেলের মায়ের নাম ডোনা সেলেন্তেস আরেন্তেস।
মজার বিষয় হচ্ছে, যে বছর পেলে জন্ম নেন, সেই বছরই ট্রেস কোরাকয়েসে পৌঁছে বিদ্যুৎ। তাই বাবা ডনডিনহো বৈদ্যুতিক বাতির (বাল্ব) আবিষ্কারক টমাস আলভা এডিসনের নামের সঙ্গে মিল রেখে ছেলের নাম রাখেন এডিসন অ্যারান্তিস দ্য নাসিমেন্তো।
অর্থাভাবে অনুশীলনের জন্য একটি বলও কিনতে পারতেন না পেলে। তাই পুরনো মোজাকে খবরের কাগজ দিয়ে মুড়িয়ে বেঁধে ফুটবল হিসেবে ব্যবহার করতেন।
আশ্চর্যের বিষয়, পেলে কীভাবে ডাকনামে পরিণত হয়, তা নিজেই জানেন না ফুটবল সম্রাট। নিজের আত্মজীবনীতেও ‘পেলে’ নামটির কোনো অর্থ তিনি বলতে পারেননি। তবে এর ব্যাখ্যা করেছেন। ব্রাজিলিয়ান ফুটবল ক্লাব ভাস্কো দ্য গামার গোলরক্ষক ছিলেন ‘বিলে’। কিন্তু ফুটবলের রাজা এই নাম কোনোভাবেই উচ্চারণ করতে পারতেন না। তার মুখ থেকে তা ‘পেলের’ মতো শোনা যেত। তাই স্কুলের বন্ধুরা তাকে পেলে নামে খ্যাপাত। এই নামটি শেষ পর্যন্ত তার ডাকনামে পরিণত হয়।
পেলে নজর কাড়েন সান্তোস ক্লাবের ওয়ালদিমার দ্য ব্রাতোর। দলটির প্রেসিডেন্টের কাছে তাকে পরিচয় করিয়ে দেওয়ার সময় ব্রাতো বলেছিলেন, এই ছেলেটি বিশ্বের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় হবে।
অলৌকিকভাবে কথাটি সত্যি প্রমাণিত হয়েছে। ১৯৫৬ সালে মাত্র ১৫ বছর বয়সে পেলে সান্তোসে যোগ দেন। খেলোয়াড়ি জীবনের প্রায় দুই দশক এই ক্লাবেই কাটান তিনি।
ইউরোপের অনেক ক্লাব থেকে খেলার অফার ও অর্থের হাতছানি আসলেও ভালোবাসার সান্তোস ছেড়ে যাননি। অবশ্য ১৯৭২ সালে সবরকম ফুটবল থেকে অবসরের দুই বছর পর আমেরিকান ক্লাব ‘নিউইয়র্ক কসমসের’ হয়ে নর্থ আমেরিকান সকার লিগে যোগ দিয়েছিলেন। ১৯৭৪ থেকে ১৯৭৬ পর্যন্ত তিনি নিউইয়র্ক কসমসের হয়ে খেলেন।
মাত্র ১৬ বছর বয়সেই পেলের জাতীয় দলে অভিষেক হয়। প্রথম ম্যাচ খেলেন চিরশত্রু আর্জেন্টিনার বিপক্ষে। সেই ম্যাচে ব্রাজিল পরাজিত হয় ২-১ গোলে। অভিষেক ম্যাচেই গোল পান পেলে। মাত্র ১৭ বছর বয়সে বিশ্বকাপ জয়ের স্বাদ পান তিনি। ১৯৫৮ সুইডেন বিশ্বকাপে করেন ৫ গোল।
ব্রাজিল এই শিরোপার মাধ্যমে দক্ষিণ আমেরিকার বাইরে ল্যাটিন কোনো দেশ হিসেবে ইউরোপ থেকে বিশ্বকাপ জয় করে। ১৯৬২ সালে গ্রুপ পর্যায়ে মাত্র এক ম্যাচ খেলে পায়ে আঘাত পাওয়ায় বিশ্বকাপের পরবর্তী ম্যাচগুলোতে আর খেলতে পারেননি। ১৯৬৬ সালে গ্রুপ পর্ব থেকেই বিদায় নেয় ব্রাজিল। ওই বিশ্বকাপে মাত্র এক গোল করেন ফুটবল সম্রাট।
১৯৭০ মেক্সিকো বিশ্বকাপে ব্রাজিলের দলটি ছিল ইতিহাসের সেরা আক্রমণাত্মক দল। দলে পেলে ছাড়াও ছিলেন রিভেলিনো, জোয়ারজিনহো, কার্লোস আলবার্তো, ফ্যালকাও, গ্যারিঞ্চার মতো তারকারা। পেলে এই বিশ্বকাপে ৪ গোল করেন। ব্রাজিলের হয়ে তিনি বিশ্বকাপে মোট ১২ গোল করেন।
১৯৭৭ সালে পেলে ক্লাব ফুটবল থেকেও অবসর নেন। নিজের হাজারতম গোলটি ব্রাজিলের বস্তিবাসী শিশুদের জন্য উৎসর্গ করেন।
ব্রাজিলের পক্ষে এখন পর্যন্ত সর্বোচ্চ গোলদাতা পেলে। ২০০৭ সালে ফিফা ৬২ বিশ্বকাপের ফাইনালের পদকটি তার হাতে তুলে দেন। ফলে পেলেই হয়ে যান তিনটি বিশ্বকাপ ফাইনাল জয় করা একমাত্র ফুটবলার। ফিফার পক্ষ থেকে তাকে সর্বকালের সর্বশ্রেষ্ঠ খেলোয়াড় ঘোষণা করা হয়।