রাজধানীতে কোথাও অগ্নিকাণ্ড, ভবনে নির্মাণত্রুটির কারণে সমস্যা, এমনকি সড়কে কোনও দুর্ঘটনা ঘটলে এর পরপরই নড়েচড়ে বসেন সংশ্লিষ্টরা। অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা দেখতে সেবা সংস্থাগুলোর তৎপরতা শুরু হয়। পরিদর্শন শেষে দেওয়া হয় নানা ধরনের পরামর্শ-উপদেশ-সাজেশন। অগুনের ঝুঁকিতে থাকা মার্কেটগুলোতে টানিয়ে দেওয়া হয় ঝুঁকিপূর্ণের ব্যানার। তবে এসব তৎপরতাকে ‘লোক দেখানো’, ‘নিজেদের দায় এড়ানোর’ কৌশল বলে অভিহিত করছেন বিশেষজ্ঞরা।তাদের অভিমত, সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাবেই কার্যকর কোনও পদক্ষেপ নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। যদিও সেবা সংস্থাগুলো বলছে, তারা তাদের আইনের মধ্যে থেকে কার্যকর ব্যবস্থা নিচ্ছে। এ ছাড়া অগ্নিদুর্ঘটনার পেছনে বিভিন্ন মার্কেট-শপিং মলের মালিকরাও কম দায়ী নন।ফায়ার সার্ভিসের তথ্য বলছে, ২০১৭ থেকে ২০১৯ সাল পর্যন্ত রাজধানীর ছোট-বড় মার্কেট, বিপণিবিতান, শপিং মলগুলো পরিদর্শন করে ৬২২টি মার্কেট এবং শপিংমল মারাত্মক ঝুঁকিতে রয়েছে, এমন তথ্য উঠে আসে। ফায়ার সার্ভিসের সেই জরিপে প্রায় ১ হাজার ৩০০টি বিপণিবিতানের তথ্য পাওয়া যায়। এসব অধিকাংশ মার্কেটেই নেই পর্যাপ্ত অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা, যন্ত্রপাতি, পানি ও ফায়ার ফাইটিং সিস্টেম। এ ছাড়া নেই ইমার্জেন্সি সিঁড়ি। মারাত্মক অগ্নিঝুঁকির তালিকায় ছিল পুড়ে যাওয়া বঙ্গবাজার মার্কেটটিও।গত ৪ এপ্রিল রাজধানীর বঙ্গবাজারে অগ্নিকাণ্ডের পর রাজধানীর বিভিন্ন জায়গায় অগ্নি প্রতিরোধব্যবস্থা পর্যবেক্ষণে সমন্বিত কার্যক্রম শুরু করেছে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, গোয়েন্দা সংস্থাসহ বিভিন্ন সংস্থা। এরই মধ্যে রাজধানীর নামিদামি মার্কেট মৌচাক মার্কেট, রাজধানী সুপারমার্কেট ও গাউছিয়া মার্কেটে অগ্নিনিরাপত্তাব্যবস্থা পরিদর্শন শেষে ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করেছে ফায়ার সার্ভিস।তবে প্রশ্ন দেখা দিয়েছে, ‘অতি ঝুঁকিপূর্ণ’ হিসেবে ঘোষণা করার পর এখন কী প্রক্রিয়ায় বা কারা এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেবে? পরবর্তী দায়িত্ব কাদের ওপর বর্তায়? যদিও এই ধরনের কার্যক্রমের সঙ্গে জড়িত রয়েছে ফায়ার সার্ভিস, সিটি করপোরেশন, বিস্ফোরক অধিদফতর, রাজধানী উন্নয়ন কর্তৃপক্ষ (রাজউক), বিস্ফোরক অধিদফতর, পরিবেশ অধিদফতর।সিটি করপোরেশনের দায়িত্বশীল কর্মকর্তারা বলছেন, ফায়ার সার্ভিস ২০১৯ সালে বঙ্গবাজারকে ‘ঝুঁকিপূর্ণ’ ঘোষণা করে। এ বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়ার জন্য বঙ্গবাজারের মালিকদের সঙ্গে যোগাযোগ করা হলেও পরবর্তীতে তারা উচ্চ আদালতে একটি মামলা করে। এরপর হাইকোর্টের স্থগিতাদেশের কারণে কার্যকর কোনও ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হয়নি। এভাবেই বিভিন্ন সময় অগ্নিঝুঁকিপূর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-সংক্রান্ত তালিকায় থাকার পরও মার্কেটগুলোর বিষয়ে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না।যদিও মার্কেট সংশ্লিষ্টদের দাবি, বিভিন্ন সময় ফায়ার সার্ভিসসহ সেবা সংস্থাগুলো মার্কেট পরিদর্শনে আসলেও পরবর্তীতে কী ব্যবস্থা রাখতে হবে, এসব বিষয়ে কার্যকর কোনও তথ্য বা পরামর্শ সংশ্লিষ্টদের জানায়নি। তবে সম্প্রতি বঙ্গবাজারে আগুন লাগার পর বেশ কয়েকটি ভবন পরিদর্শনে গিয়ে লিখিতভাবে কার্যকর কী কী ব্যবস্থা নিতে হবে, এসব বিষয়ে জানানো হচ্ছে।
ফায়ার সার্ভিসের উপসহকারী পরিচালক হাফিজুর রহমান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, এরই মধ্যে বেশ কয়েকটি মার্কেটের অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা এবং মার্কেটের ঝুঁকির বিষয়টি পরিদর্শন করেছি। কিন্তু অগ্নিনির্বাপণব্যবস্থা ছিল অপ্রতুল। আমরা লিখিতভাবে কী কী বিষয় যোগ করতে হবে এসব জানিয়ে এসেছি। তারা এগুলো সঠিকভাবে বাস্তবায়ন করবে বলে আমাদের জানিয়েছে। সম্প্রতি যেসব মার্কেটগুলো পরিদর্শন করা হয়েছে সেই মার্কেটগুলোতে দেখা গেছে, ফায়ার ব্রিগেড কানেকশন (পানি সরবরাহের কানেকশন) নেই, ফায়ার হাইড্রেন্ট নেই, পানির কোনও পাম্প নেই। আগুন লাগলে বোঝার জন্য এলার্ম সিস্টেম নেই। আগুন লাগলে দ্রুত বাইরে বের হওয়ার পথ নেই। সিঁড়ি অপ্রতুল পাওয়া গেছে মার্কেটগুলোতে। এসব বিষয় প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিতে নির্দেশনা দেওয়া হয়েছে।মৌচাক মার্কেট মালিক সমিতির সিনিয়র সহ-সভাপতি সাইদুর রহমান পিন্টু অভিযোগ করেন, এর আগে ফায়ার সার্ভিস এবং অনেকেই মার্কেট পরিদর্শন করে গিয়েছেন। কিন্তু কী ব্যবস্থা নিতে হবে এ বিষয়ে সঠিক কোনও তথ্য দেননি। তবে এবার লিখিত আকারে সাজেশন দিয়ে গিয়েছে কী ধরনের পরিবর্তন আনতে হবে, কী কী করা লাগবে।ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশনের মেয়র ব্যারিস্টার শেখ ফজলে নূর তাপস বলেন, সিটি করপোরেশন এবং অন্যান্য সংস্থা যেসব জায়গা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করেছে, সেগুলো যেন এখন থেকে ব্যবহার না করা হয়। কারণ কোথায় কখন দুর্ঘটনা ঘটে যায় তা বলা সম্ভব নয়। আমরা ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে চিহ্নিত করে দিয়েছি। যারা ব্যবহার করে তাদেরও দায়িত্ব বর্তায়। তারা যেন সেই ঝুঁকিটাকে মাথায় নিয়ে যথাযথভাবে ব্যবহার করে।ইনস্টিটিউট ফর প্ল্যানিং অ্যান্ড ডেভেলপমেন্টের নির্বাহী পরিচালক অধ্যাপক ডক্টর আদিল মুহাম্মদ খান বাংলা ট্রিবিউনকে বলেন, রাজধানীর কোথাও অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা ঘটলেই এরপর দেখা যায় সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ে বিভিন্ন জায়গায় অভিযান এবং পরিদর্শনের ব্যবস্থা করা হয়। এটি শুধু নিজেদের ওপর দায় এড়ানোর স্বার্থেই এ ধরনের উদ্যোগ নেওয়া হয়ে থাকে। সেবা সংস্থাগুলোর সমন্বয়ের অভাবে রাজধানীর বিভিন্ন ভবন এবং মার্কেটে কার্যকর ব্যবস্থা নেওয়া যাচ্ছে না।এ কারণেই আগুনের ঘটনা ঘটে চলছে।