ঢাকা , শুক্রবার, ২৯ নভেম্বর ২০২৪, ১৪ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
Logo সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের রফিনগর গ্রামের সাজ্জাতুলের বাড়িঘরে হামলা,ভাংচুর লুটপাঠসহ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ভাংচুরের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন Logo বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত -নিহতদের স্মরণে দোয়ারাবাজারে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত Logo অন্তবর্তীকালীন সরকার পতনের ষড়যন্ত্র গোপন বৈঠকে থাকা ছাত্রলীগের ৩৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি Logo শান্তিগঞ্জে বিনামূল্যে গরু বিতরণের লক্ষ্যে অবহিতকরণ সভা ও প্রশিক্ষণ Logo দোয়ারাবাজারে সরকারি গাছ কর্তন।। জব্দ করলো প্রশাসন Logo শান্তিগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা  Logo ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের স্মরণে তাহিরপুরে’স্মরণ সভা’ Logo ছাত্র-জনতার গণঅভ্যুত্থানে আহত ও শহিদদের স্মরণে শান্তিগঞ্জে ‘স্মরণ সভা’ Logo চলছে ধান কাটা ও মাড়াইয়ের কাজ বাম্পার ফলনে শান্তিগঞ্জের কৃষকের মুখে হাসি Logo জুলাই-আগষ্টের ছাত্র-জনতার গণঅদ্ভুত্থানে আহত ও শহীদদের স্মরণে ছাতকে স্মরণ সভা

৭ মার্চ ১৯৭১ঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ

শীতের রুক্ষতার পরে যেমন প্রকৃতিতে ফল্গু-হাওয়া নিয়ে আসে বসন্ত, তেমনি ১৯৭১ সালে মার্চ মাস এসেছিল বাঙালি জাতির নব-জীবনের জন্য প্রাণ-সঞ্চারণী বার্তা নিয়ে। জনতার বুকের রক্তে-রাঙা সেই ব্যতিক্রমী বসন্তের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি নির্দেশে চলতে শুরু করে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জানান- ৭ তারিখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-সমাবেশ করা হবে, সেদিনই দেওয়া হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা। সাত কোটি বাঙালির আশা-ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয় দিনটি। এদিনই দশ লক্ষাধিক মানুষের উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিনের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রণ-কৌশলের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু।পরবর্তীতে এই ভাষণটিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ ও বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। পুরো বিশ্বের জন্য এই ভাষণটিকে একটি প্রামাণ্য দলিল বলে অভিহিত করে ইউনেস্কো। কারণ, এটি শুধু কোনো রাজনৈতিক বা যুদ্ধের ভাষণ নয়। এই ভাষণটিতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের ভাগ্য বদলের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অসহযোগ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে অস্ত্রের মোকাবিলায় প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহারের জন্যেও ঘরে ঘরে প্রস্তুতি ও গণপ্রতিরোধের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে এই ভাষণে। নিয়মতান্ত্রিক অথচ পুরোদুস্তুর গেরিলা যুদ্ধ-প্রস্তুতির ঘোষণা, বিপ্লবের ডাক অথচ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাত কোটি জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা- এটি শুধু ৭ মার্চের ভাষণেই সম্ভব হয়েছে। একারণে বিশ্ববাসীর কাছে আজ এই ভাষণ একটি অনবদ্য বিশ্ব-ঐতিহ্য। আর আমাদের কাছে এই ভাষণ হলো- মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রণ-কৌশল ও দিক-নির্দেশনা।

বহুল প্রতীক্ষিত ৭ মার্চের ভাষণের আগে কী করছিলেন বঙ্গবন্ধু

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, সকাল থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক ভবনে ভিড় জমাতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা। ছাত্রনেতাদের ভিড় ছিল পুরো সময়জুড়ে। এসময় নিজ বাসভবনে শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ছাত্র নেতাদের তিনি জানান, বিকালে রেসকোর্সে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায়) চার-দফা দাবি পেশ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর জামাতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী, সাবেক ডাকসু নেতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় এই তথ্য জানিয়েছেন।২০১৬ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ জানান, ৬ মার্চ সন্ধ্যায় ও ৭ মার্চ দিনের বেলা দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে শুধু এই চার দফার ব্যাপারেই আলোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাকি সব কথার কোনো ড্রাফট ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন।’তোফায়েল আহমেদ আরো জানান- ৭ মার্চ দুপুর ২টার পর বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিতে ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বের হন, সেসময় তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে।’তিনি আরো জানান- এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে সকাল থেকেই গণসঙ্গীত চলছিল। সেদিন শেখ মুজিব সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন।জনসভায় ছিলেন এমন অনেকের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়- সেদিন সকাল থেকে লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত শ্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নিরবতা। ভাষণ শেষে আবারও স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

৭ মার্চের সেই জনসভার জন্য, বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় ছিল বেলা ২টায়। বেলা ১১টার মধ্যেই রেসকোর্স পরিণত হয় জনসমুদ্রে।বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই মমিনুল হক খোকা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল, বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ নামে ২০০০ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি জানান, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটি চালিয়েছিলেন তিনি নিজে।এদিকে বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া এবং বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাকের ওপর। তখন তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান। আর রেসকোর্সে মঞ্চের নিরাপত্তার অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার কামরুল আলম খান খসরু (পরে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার নায়ক)।আব্দুর রাজ্জাক তার স্মৃতিচারণায় জানান, সকাল থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। ঠিক হয় তিনটি গাড়ি এক সঙ্গে রেসকোর্সে যাবে। দুটি গাড়িতে থাকবে যাদের গোঁফ আছে এবং তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি। চুল থাকবে ব্যাক ব্রাশ করা। সামনের গাড়িতে ছাত্রনেতারা। ঠিক দুইটার সময় ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু। তবে ৩২ নম্বর থেকে এলিফ্যান্ট রোড, তৎকালীন পিজি হাসপাতালের পাশ দিয়ে রেসকোর্সে যাওয়ার কথা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা বদলে ফেলা হয়। এরপর নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছান তারা।বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে রেসকোর্সে নেওয়া এবং মঞ্চের নিরাপত্তা নিয়ে বর্ণনা পাওয়া যায় কামরুল আলম খান খসরুর লেখায়। তিনি জানান, ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনটি দল গঠন করা হয়েছিল সেদিন। একটি দল বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসা-যাওয়া করার জন্য। ভাষণের সময় মঞ্চের নিচে থাকার জন্য একটি দল। মঞ্চের আশেপাশে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার জন্য আরেকটি দল।

বঙ্গবন্ধুকে কমান্ডো অ্যাটাকে হত্যা ও গ্রেফতারের সম্ভাবনা

সমাবেশ শেষে আবারো সোজা পথে ধানমন্ডি না ফিরে- শাহজাহানপুর, মতিঝিল কলোনির পাশ দিয়ে শেরেবাংলা নগর হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার বহরটি ফেরে ৩২ নম্বরের বাড়িতে।এতো নিরাপত্তার কারণ হিসেবে তারা সবাই জানিয়েছেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র চারিদিকে। বলা হয়েছিল, কমান্ডো অ্যাটাক করে হত্যা করা হবে। আকাশে হেলিকপ্টারও ঘুরছিল। অ্যাটাক হলে বাঁচানো যেতো না। তাই এই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে।ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতিকথা থেকে আরো জানা যায়, ভাষণের পর বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের সবার সঙ্গে বসে রাতের খাবার খান বঙ্গবন্ধু। সেসময় তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার যা বলার ছিল, আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু-বেলা আমার সঙ্গে খাবে।’

৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বাঙালিদের হাতে

মূলত, ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই দেশজুড়ে হানাদার প্রতিরোধ কমিটি গড়ে উঠতে শুরু করে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ। দেশজুড়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের মহড়া। পরবর্তীতে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি জান্তারা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর, মোক্ষম সময় বুঝে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ বলে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। অয়্যারলেসের বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে এই ঘোষণা শুনে দ্রুত তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গণে নেমে আসে আপামর জনতা। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি আমরা। অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা।৭ মার্চের ভাষণের মাহাত্ম্য এখানেই আলাদা। মার্চের চলমান আন্দোলনের মধ্যে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন থেকেই তার ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে জান্তারা। এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপর সেদিন সকাল থেকেই টহল দিতে শুরু করে পাকিস্তানি বোমারু বিমান ও হেলিকপ্টার। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসের পাশে মোতায়েন করা হয় গোলাভর্তি ট্যাংক। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে জনসমুদ্রে বোমা মেরে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় জান্তারা। ফলে কৌশলি সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু।সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে, পাকিস্তানিদের প্রতি চারটি শর্ত আরোপ করেন তিনি। সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাদের ব্যারাকে ফেরত, মার্চে দেশজুড়ে জান্তা কর্তৃক গণহত্যার বিচার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি। এছাড়াও বাঙালিদের প্রতি দশটি নির্দেশনা জারি করেন। খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ, অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, যানবাহন বন্ধ, কালো পতাকা উত্তোলন, সংগ্রাম পরিষদ গঠনসহ দশটি নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপরেই কার্যত রাষ্ট্রক্ষমতার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালিদের হাতে।

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

Janasarthe 24

আপনাদের আশে পাশে ঘটে যাওয়া প্রতি মুহুর্তের খবর দিয়ে আমাদের সহযোগীতা করুন। আমরা আমাদের অনলাইনে তা প্রকাশ করে কৃতজ্ঞ হবো। আমাদের প্রতি মুহুর্তের খবর জানতে আমাদের সাথে থাকুন
জনপ্রিয় সংবাদ

সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের রফিনগর গ্রামের সাজ্জাতুলের বাড়িঘরে হামলা,ভাংচুর লুটপাঠসহ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ভাংচুরের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন

৭ মার্চ ১৯৭১ঃ বঙ্গবন্ধুর ভাষণের আগে ঘটে যাওয়া ঐতিহাসিক ঘটনাপ্রবাহ

আপডেট সময় ০৯:৪৮:১১ পূর্বাহ্ন, মঙ্গলবার, ৭ মার্চ ২০২৩

শীতের রুক্ষতার পরে যেমন প্রকৃতিতে ফল্গু-হাওয়া নিয়ে আসে বসন্ত, তেমনি ১৯৭১ সালে মার্চ মাস এসেছিল বাঙালি জাতির নব-জীবনের জন্য প্রাণ-সঞ্চারণী বার্তা নিয়ে। জনতার বুকের রক্তে-রাঙা সেই ব্যতিক্রমী বসন্তের প্রথম দিন থেকেই উত্তাল হয়ে ওঠে ঢাকা। জাতির জনক বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের সরাসরি নির্দেশে চলতে শুরু করে বাংলাদেশের প্রশাসনিক কাঠামো। ৩ মার্চ পল্টনের জনসভায় বঙ্গবন্ধু জানান- ৭ তারিখ সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে গণ-সমাবেশ করা হবে, সেদিনই দেওয়া হবে চূড়ান্ত নির্দেশনা। সাত কোটি বাঙালির আশা-ভরসার কেন্দ্রে পরিণত হয় দিনটি। এদিনই দশ লক্ষাধিক মানুষের উত্তাল জনসমুদ্রে দাঁড়িয়ে দীর্ঘদিনের মুক্তিসংগ্রামের চূড়ান্ত পরিণতির জন্য পৃথিবীর শ্রেষ্ঠ রণ-কৌশলের ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু।পরবর্তীতে এই ভাষণটিকে পৃথিবীর অন্যতম শ্রেষ্ঠ ভাষণ ও বিশ্ব প্রামাণ্য ঐতিহ্য বলে স্বীকৃতি দেয় জাতিসংঘ। পুরো বিশ্বের জন্য এই ভাষণটিকে একটি প্রামাণ্য দলিল বলে অভিহিত করে ইউনেস্কো। কারণ, এটি শুধু কোনো রাজনৈতিক বা যুদ্ধের ভাষণ নয়। এই ভাষণটিতে নিপীড়িত-নির্যাতিত মানুষের ভাগ্য বদলের কথা বলা হয়েছে। মানবাধিকার লঙ্ঘনের বিরুদ্ধে অসহযোগ ও শান্তিপূর্ণ আন্দোলনের কথা বলা হয়েছে। একই সঙ্গে অস্ত্রের মোকাবিলায় প্রয়োজনে অস্ত্র ব্যবহারের জন্যেও ঘরে ঘরে প্রস্তুতি ও গণপ্রতিরোধের নির্দেশনাও দেওয়া হয়েছে এই ভাষণে। নিয়মতান্ত্রিক অথচ পুরোদুস্তুর গেরিলা যুদ্ধ-প্রস্তুতির ঘোষণা, বিপ্লবের ডাক অথচ পুরোপুরি গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় সাত কোটি জনগণকে এর সঙ্গে সম্পৃক্ত করা- এটি শুধু ৭ মার্চের ভাষণেই সম্ভব হয়েছে। একারণে বিশ্ববাসীর কাছে আজ এই ভাষণ একটি অনবদ্য বিশ্ব-ঐতিহ্য। আর আমাদের কাছে এই ভাষণ হলো- মুক্তিযুদ্ধের চূড়ান্ত রণ-কৌশল ও দিক-নির্দেশনা।

বহুল প্রতীক্ষিত ৭ মার্চের ভাষণের আগে কী করছিলেন বঙ্গবন্ধু

১৯৭১ সালের ৭ মার্চ, সকাল থেকেই ধানমন্ডি ৩২ নম্বর রোডের ঐতিহাসিক ভবনে ভিড় জমাতে শুরু করেন নেতাকর্মীরা। ছাত্রনেতাদের ভিড় ছিল পুরো সময়জুড়ে। এসময় নিজ বাসভবনে শীর্ষ আওয়ামী লীগ নেতাদের সঙ্গে ঘণ্টাব্যাপী বৈঠক করেন বঙ্গবন্ধু। এরপর ছাত্র নেতাদের তিনি জানান, বিকালে রেসকোর্সে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের জনসভায়) চার-দফা দাবি পেশ করা হবে। বঙ্গবন্ধুর জামাতা, প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনার স্বামী, সাবেক ডাকসু নেতা ড. এম এ ওয়াজেদ মিয়া তার স্মৃতিকথায় এই তথ্য জানিয়েছেন।২০১৬ সালে বিবিসিকে দেওয়া এক সাক্ষাৎকারে বঙ্গবন্ধুর ঘনিষ্ঠ ছাত্রনেতা তোফায়েল আহমেদ জানান, ৬ মার্চ সন্ধ্যায় ও ৭ মার্চ দিনের বেলা দলীয় সহকর্মীদের সঙ্গে বৈঠকে শুধু এই চার দফার ব্যাপারেই আলোচনা করেছিলেন বঙ্গবন্ধু। বাকি সব কথার কোনো ড্রাফট ছিল না। ৭ মার্চের ভাষণ তিনি নিজের চিন্তা থেকেই দিয়েছিলেন।’তোফায়েল আহমেদ আরো জানান- ৭ মার্চ দুপুর ২টার পর বঙ্গবন্ধু যখন ভাষণ দিতে ৩২ নম্বরের বাসা থেকে বের হন, সেসময় তার স্ত্রী শেখ ফজিলাতুন্নেসা মুজিব তাকে বলেছিলেন, ‘তুমি যা বিশ্বাস করো, তাই বলবে।’তিনি আরো জানান- এদিকে সকাল থেকেই রাজধানী ঢাকা পরিণত হয়েছিল মিছিলের নগরীতে। রেসকোর্স ময়দানের মঞ্চে সকাল থেকেই গণসঙ্গীত চলছিল। সেদিন শেখ মুজিব সেই মঞ্চে একাই ভাষণ দিয়েছিলেন। এই একটি ভাষণের মাধ্যমে তিনি একটি নিরস্ত্র জাতিকে সশস্ত্র জাতিতে রূপান্তর করেছিলেন।জনসভায় ছিলেন এমন অনেকের সাক্ষাৎকার থেকে জানা যায়- সেদিন সকাল থেকে লাঠি, ফেস্টুন হাতে লাখ লাখ মানুষ উত্তপ্ত শ্লোগানে মুখরিত থাকলেও শেখ মুজিবের ভাষণের সময় সেখানে ছিল পিনপতন নিরবতা। ভাষণ শেষে আবারও স্বাধীনতার পক্ষে স্লোগান মুখর হয়ে উঠেছিল ঢাকার রাস্তাগুলো।

ধানমন্ডি ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যান

৭ মার্চের সেই জনসভার জন্য, বঙ্গবন্ধুর সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে (রেসকোর্স ময়দানে) পৌঁছানোর নির্ধারিত সময় ছিল বেলা ২টায়। বেলা ১১টার মধ্যেই রেসকোর্স পরিণত হয় জনসমুদ্রে।বঙ্গবন্ধুর ফুপাতো ভাই মমিনুল হক খোকা সেদিনের স্মৃতিচারণ করে ‘অস্তরাগে স্মৃতি সমুজ্জ্বল, বঙ্গবন্ধু, তাঁর পরিবার ও আমি’ নামে ২০০০ সালে একটি বই প্রকাশ করেন। সেখানে তিনি জানান, সেদিন বঙ্গবন্ধুকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে যে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সেটি চালিয়েছিলেন তিনি নিজে।এদিকে বঙ্গবন্ধুকে ৩২ নম্বর থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে যাওয়া এবং বাড়িতে পৌঁছে দেওয়ার দায়িত্ব ছিল তৎকালীন ছাত্রনেতা আব্দুর রাজ্জাকের ওপর। তখন তিনি আওয়ামী স্বেচ্ছাসেবক বাহিনীর প্রধান। আর রেসকোর্সে মঞ্চের নিরাপত্তার অন্যতম দায়িত্বে ছিলেন স্বাধীনতাযুদ্ধে ঢাকা অঞ্চলের গেরিলা কমান্ডার কামরুল আলম খান খসরু (পরে ‘ওরা ১১ জন’ সিনেমার নায়ক)।আব্দুর রাজ্জাক তার স্মৃতিচারণায় জানান, সকাল থেকেই তিনি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ছিলেন। ঠিক হয় তিনটি গাড়ি এক সঙ্গে রেসকোর্সে যাবে। দুটি গাড়িতে থাকবে যাদের গোঁফ আছে এবং তাদের পরনে থাকবে পাঞ্জাবি। চুল থাকবে ব্যাক ব্রাশ করা। সামনের গাড়িতে ছাত্রনেতারা। ঠিক দুইটার সময় ৩২ নম্বরের বাড়ি থেকে বের হন বঙ্গবন্ধু। তবে ৩২ নম্বর থেকে এলিফ্যান্ট রোড, তৎকালীন পিজি হাসপাতালের পাশ দিয়ে রেসকোর্সে যাওয়ার কথা থাকলেও তাৎক্ষণিকভাবে তা বদলে ফেলা হয়। এরপর নিউমার্কেট, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হয়ে হাইকোর্টের পাশ দিয়ে রেসকোর্স ময়দানে পৌঁছান তারা।বঙ্গবন্ধুকে বাড়ি থেকে রেসকোর্সে নেওয়া এবং মঞ্চের নিরাপত্তা নিয়ে বর্ণনা পাওয়া যায় কামরুল আলম খান খসরুর লেখায়। তিনি জানান, ৫০ জন স্বেচ্ছাসেবক নিয়ে তিনটি দল গঠন করা হয়েছিল সেদিন। একটি দল বঙ্গবন্ধুকে বাসা থেকে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে নিয়ে আসা-যাওয়া করার জন্য। ভাষণের সময় মঞ্চের নিচে থাকার জন্য একটি দল। মঞ্চের আশেপাশে সার্বক্ষণিক দৃষ্টি রাখার জন্য আরেকটি দল।

বঙ্গবন্ধুকে কমান্ডো অ্যাটাকে হত্যা ও গ্রেফতারের সম্ভাবনা

সমাবেশ শেষে আবারো সোজা পথে ধানমন্ডি না ফিরে- শাহজাহানপুর, মতিঝিল কলোনির পাশ দিয়ে শেরেবাংলা নগর হয়ে বঙ্গবন্ধুকে নিয়ে তার বহরটি ফেরে ৩২ নম্বরের বাড়িতে।এতো নিরাপত্তার কারণ হিসেবে তারা সবাই জানিয়েছেন, তখন বঙ্গবন্ধুকে হত্যার ষড়যন্ত্র চারিদিকে। বলা হয়েছিল, কমান্ডো অ্যাটাক করে হত্যা করা হবে। আকাশে হেলিকপ্টারও ঘুরছিল। অ্যাটাক হলে বাঁচানো যেতো না। তাই এই সতর্কতা অবলম্বন করতে হয়েছে।ওয়াজেদ মিয়ার স্মৃতিকথা থেকে আরো জানা যায়, ভাষণের পর বাসায় ফিরে পরিবারের সদস্যদের সবার সঙ্গে বসে রাতের খাবার খান বঙ্গবন্ধু। সেসময় তিনি তাদের উদ্দেশে বলেন, ‘আমার যা বলার ছিল, আজকের জনসভায় তা প্রকাশ্যে বলে ফেলেছি। সরকার এখন আমাকে যে কোনো মুহূর্তে গ্রেফতার করতে পারে। সেজন্য আজ থেকে তোমরা প্রতিদিন দু-বেলা আমার সঙ্গে খাবে।’

৭ মার্চের পর বঙ্গবন্ধুর মাধ্যমে বাংলাদেশের নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বাঙালিদের হাতে

মূলত, ৭ মার্চের ভাষণের পরপরই দেশজুড়ে হানাদার প্রতিরোধ কমিটি গড়ে উঠতে শুরু করে। দেশের প্রতিটি অঞ্চলে আওয়ামী লীগের নেতৃত্বে গড়ে ওঠে সংগ্রাম পরিষদ। শুরু হয় অস্ত্র সংগ্রহ ও প্রশিক্ষণ। দেশজুড়ে শুরু হয় মুক্তিযুদ্ধের মহড়া। পরবর্তীতে ২৫ মার্চ পাকিস্তানি জান্তারা ঘুমন্ত বাঙালির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ার পর, মোক্ষম সময় বুঝে ২৬ মার্চ প্রথম প্রহরে ‘আজ থেকে বাংলাদেশ স্বাধীন’ বলে সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দেন বঙ্গবন্ধু। অয়্যারলেসের বিশেষ ফ্রিকোয়েন্সিতে এই ঘোষণা শুনে দ্রুত তাকে গ্রেফতার করে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী। কিন্তু জীবন বাজি রেখে রণাঙ্গণে নেমে আসে আপামর জনতা। দীর্ঘ ৯ মাসের যুদ্ধ শেষে বিজয়ী জাতি হিসেবে আত্মপ্রকাশ করি আমরা। অর্জিত হয় মহান স্বাধীনতা।৭ মার্চের ভাষণের মাহাত্ম্য এখানেই আলাদা। মার্চের চলমান আন্দোলনের মধ্যে ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যখন চূড়ান্ত নির্দেশনা দেওয়ার ঘোষণা দিলেন, তখন থেকেই তার ওপর চাপ বাড়াতে শুরু করে জান্তারা। এমনকি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওপর সেদিন সকাল থেকেই টহল দিতে শুরু করে পাকিস্তানি বোমারু বিমান ও হেলিকপ্টার। এমনকি ঢাকা সেনানিবাসের পাশে মোতায়েন করা হয় গোলাভর্তি ট্যাংক। সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা দিলে জনসমুদ্রে বোমা মেরে লাখ লাখ সাধারণ মানুষকে মেরে ফেলার হুমকিও দেয় জান্তারা। ফলে কৌশলি সিদ্ধান্ত নেন বঙ্গবন্ধু।সরাসরি স্বাধীনতার ঘোষণা না দিয়ে, পাকিস্তানিদের প্রতি চারটি শর্ত আরোপ করেন তিনি। সামরিক আইন প্রত্যাহার, সেনাদের ব্যারাকে ফেরত, মার্চে দেশজুড়ে জান্তা কর্তৃক গণহত্যার বিচার ও নির্বাচিত জনপ্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি জানান তিনি। এছাড়াও বাঙালিদের প্রতি দশটি নির্দেশনা জারি করেন। খাজনা-ট্যাক্স বন্ধ, অফিস-আদালত-শিক্ষাপ্রতিষ্ঠান বন্ধ, যানবাহন বন্ধ, কালো পতাকা উত্তোলন, সংগ্রাম পরিষদ গঠনসহ দশটি নির্দেশনা প্রদান করেন। এরপরেই কার্যত রাষ্ট্রক্ষমতার পুরো নিয়ন্ত্রণ চলে আসে বঙ্গবন্ধু তথা বাঙালিদের হাতে।