ভূক্তভোগীদের নিকট নিজেকে একজন ‘কাস্টমস অফিসার’ হিসেবে পরিচয় দিতেন যা ছিল সবই সাজানো নাটক। আর এভাবেই প্রতারণা করে কোটি কোটি টাকা আত্মসাৎকারী সংঘবদ্ধ প্রতারক চক্রের মূলহোতা নজরুল ইসলামকে তিন সহযোগীসহ নারায়ণগঞ্জ থেকে গ্রেপ্তার করেছে র্যাব-১০।
গ্রেপ্তারকৃতরা হলো চক্রটির মূলহোতা মো. নজরুল ইসলাম ও তার তিন সহযোগী মো. ওয়ায়েশ করোনী ওরফে সেলিম, মো. নাসির উদ্দিন, মো. হাবিব হোসেন, সৈয়দ মো. এনায়েত।
এসময় তাদের কাছ থেকে প্রতারনার কাজে ব্যবহৃত ভুয়া কাস্টমস কর্মকর্তার ইউনিফর্ম, আইডি কার্ড, ওয়াকিটকি, বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের ভুয়া সীল, স্টীকার, ভিজিটিং কার্ড, নগদ অর্থ, বিভিন্ন ব্যাংকের এটিম কার্ড ও চেক বহি, মোবাইল, ১টি প্রাইভেটকার ও ২টি মোটরসাইকেলসহ বিভিন্ন সরঞ্জামাদি উদ্ধার করা হয় ।
বুধবার (১৬ আগষ্ট) দুপুরে গণমাধ্যমে পাঠানো এক সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে এ তথ্য নিশ্চিত করা হয়। এরআগে মঙ্গলবার দিবাগত রাতে নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জে অভিযান চালিয়ে তাদের গ্রেপ্তার করা হয়।
প্রাথমিক জিজ্ঞাসাবাদে র্যাব জানতে পারে, উচ্চাভিলাশী জীবন-যাপন করার উদ্দেশ্যে এই চক্রটি প্রতারণার কাজ বেছে নেয়। চক্রটি প্রায় ২ বছর যাবৎ এই প্রতারণা কার্যক্রম পরিচালনা করে আসছে। চক্রটির মোট সদস্য সংখ্যা ৭-৮ জন এবং চক্রটির মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত নজরুল।
চক্রের অন্যান্য সদস্যরা বিভিন্ন এলাকার চাকুরী প্রত্যাশীদের অর্থের বিনিময়ে চাকুরী দেয়ার কথা বলে এই চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত নজরুলের নিকট নিয়ে আসত। নজরুল কাস্টমস এর ইউনিফরম পরিহিত অবস্থায় চাকুরী প্রত্যাশীদের বলত যে, কাস্টমসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের উর্দ্ধতন কর্মকর্তাদের সাথে তার সু-সম্পর্ক রয়েছে।
এভাবেই চাকুরী প্রত্যাশীদের বিশ^াস অর্জন করে এবং চাকুরী দেওয়ার কথা বলে নগদ অর্থ হাতিয়ে নিত। তারা প্রতারণার মাধ্যমে চাকুরী দেয়াসহ বিদেশে পাঠানোর কথা বলে অসংখ্য ব্যক্তির নিকট হতে প্রতারণার মাধ্যমে প্রায় কোটি কোটি টাকা হাতিয়ে নিয়েছে।
এছাড়াও চক্রটি তাদের গাড়ীতে বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের স্টিকার ব্যবহার করে প্রতারণা মূলকভাবে রাজধানী ঢাকাসহ নারায়ণগঞ্জের স্থানীয় ব্যবসায়ীসহ ঢাকার বাহিরে বিভিন্ন রিসোর্ট ও ব্যবসায়ীদের রাজস্ব ফাঁকি দেয়ার ভয়ভীতি দেখিয়ে অর্থ হাতিয়ে নিত। গ্রেপ্তারকৃত নজরুল মূলত চক্রের অন্যান্য সহযোগীদের যোগসাজসে মিথ্যা তথ্যের মাধ্যমে প্রতারণা করে আসছিল। চক্রটির স্থায়ীভাবে কোন অফিস ছিল না বিধায় গ্রেপ্তারকৃত ওয়ায়েশ করোনীর নারায়ণগঞ্জের সিদ্ধিরগঞ্জের সাইনবোর্ড এলাকায় ভাড়া বাসাকে তারা অস্থায়ী অফিস হিসেবে ব্যবহার করে আসছিল। আত্মগোপনের জন্য তারা প্রায়শই নিজেদের মোবাইল নম্বর বন্ধ রেখে নিকট আত্মীয় ও বন্ধু-বান্ধবের বাসায় অবস্থান করত।
পরবর্তীতে ২০১৩ সালে নৈশ প্রহরী এবং ২০১৭ সালে উচ্চমান সহকারী হিসেবে চাকুরী পাওয়ার উদ্দেশ্যে পুনরায় আবেদন করে এবং পুনরায় প্রতারিত হয়। বিভিন্ন সময়ে কাস্টমসে চাকুরীর পরীক্ষায় অংশগ্রহণ এবং কাস্টমসের বিভিন্ন কর্মকর্তা কর্মচারীদের সান্নিধ্যে আসার সুবাধে কাস্টমসের বিভিন্ন কার্যক্রম সম্পর্কে সে সম্যক ধারণা লাভ করে।
সে নিজে প্রতারিত হয়ে পরবর্তীতে উচ্চাভিলাশী জীবন-যাপনের উদ্দেশ্যে সাধারণ মানুষের সাথে প্রতারণা করে অর্থ আত্মসাতের লোভে একটি প্রতারক চক্র গড়ে তোলে।
প্রতারণা করার জন্য সে নিজেকে এলাকায় উর্ধ্বতন কাস্টমস অফিসার হিসেবে পরিচয় দিতো। সে কাস্টমসসহ বিভিন্ন সরকারি প্রতিষ্ঠানের কর্মকর্তাদের সাথে সুসর্ম্পক রয়েছে বলে মিথ্যা তথ্য প্রদান করত। পরবর্তীতে কাস্টমসের বিভিন্ন পদে (পিওন, ঝাড়ুদার ও অন্যান্য পদে) চাকুরী প্রদান করে বিভিন্ন চাকুরী প্রত্যাশীদের কাছে বিশ^স্ততা অর্জন করে।
মূলত সে কাস্টমসের এ্যাসিস্টেন্ট কমিশনার ও রেভিনিউ অফিসার সুপারিনটেনডেন্ট কর্মকর্তা পরিচয়ে এই প্রতারণার কার্যক্রম পরিচালনা করত। এছাড়াও সে বিমানবন্দর ও স্থলবন্দরে দেশের বাহিরে থেকে আসা স্বর্ণ ও মালামাল অর্থের বিনিময়ে ছাড়িয়ে দেয়ার কথা বলে প্রতারণামূলক কার্যক্রমের মাধ্যমে অর্থ আত্মসাৎ করত।
সে নারায়ণগঞ্জে একটি রাইস এজেন্সি পরিচালনা করত এবং সে আদম ব্যবসার সাথে জড়িত রয়েছে। বিভিন্ন প্রতারণার মাধ্যমে আত্মসাৎকৃত অর্থ দিয়ে সে ফ্ল্যাট বুকিং, জমি ক্রয়, বাড়ি ও বিভিন্নভাবে তার নামে অর্থ সম্পদ গড়ে তোলে। গ্রেপ্তারকৃত ওয়ায়েশ করোনী ওরফে সলিম দীর্ঘদিন প্রবাসে অবস্থান করে দেশে এসে একটি এজেন্সিতে চাকুরী শুরু করে। পরবর্তীতে গ্রেপ্তারকৃত নজরুলের সাথে তার প্রায় ১০-১১ বছরের পরিচয়ের সুবাদে এই প্রতারণা চক্রের সাথে সম্পৃক্ত হয়।
সে মূলত নজরুলের প্রধান সহযোগী হিসেবে কাজ করত। আদম ব্যবসার মাধ্যমে প্রতারণা করে বিদেশে লোক পাঠানো এবং ভিসা তৈরির জন্য মূলত সে দায়িত্বপ্রাপ্ত ছিল। সে এশিয়া, মধ্যপ্রাচ্যসহ বিভিন্ন দেশে লোক পাঠানোর কাজ করত বলে জানা যায়। গ্রেপ্তারকৃত সৈয়দ মো. এনায়েত ঢাকায় পাঠাও চালক হিসেবে গাড়ী চালাতো। বিগত প্রায় ১ বছর পূর্বে নজরুলের সাথে তার পরিচয় হয়। পরিচয়ের সুবাদে সে গ্রেফতারকৃত নজরুলের পরামর্শে মাসে ২০ হাজার টাকা চুক্তিতে একটি প্রাইভেটকার ভাড়া করে এই চক্রের সাথে যুক্ত হয়। সে মূলত চাকুরী প্রত্যাশীদেরকে নজরুলের কাছে নিয়ে আসতো এবং নজরুলের ড্রাইভার পরিচয় দিত। গ্রেপ্তারকৃত নাসির উদ্দিন ওরফে আবির চক্রের মূলহোতা নজরুল এর চালের দোকানের কর্মচারী ছিল এবং মোটরসাইকেল চালাতো। সে মূলত চাকুরী প্রত্যাশীদেরকে গ্রেপ্তারকৃত নজরুলের কাছে নিয়ে আসতো এবং চক্রের মূলহোতা গ্রেপ্তারকৃত নজরুলের পিএস পরিচয় দিত।
সংবাদ বিজ্ঞপ্তিতে উল্লেখ করা রয়েছে গ্রেপ্তারকৃতদের বিরুদ্ধে আইনানুগ ব্যবস্থা প্রক্রিয়াধীন রয়েছে।