বাংলাদেশে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন লঙ্ঘনের অভিযোগে দায়ের হওয়া মামলায় সাংবাদিকসহ উল্লেখযোগ্য সংখ্যক মানুষ গ্রেফতারের পর মাসের পর মাস জেল খাটছেন।এই মামলায় সাংবাদিক হয়রানির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও অন্য অনেকের ভোগান্তির কথা অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।এমন অবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি নিবর্তনমূলক আইন আখ্যা দিয়ে শুরু থেকেই আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে আইনজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন।তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলাকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।মামলাটি বাতিলের দাবিতে দীর্ঘসময় আন্দোলন করে আসছেন অধিকার কর্মী ও লেখক সায়দিয়া গুলরুখ। তার মতে এই মামলার সবচেয়ে বিতর্কিত দুটি বিষয় হল এখানে মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় এবং আইনের বেশ কয়েকটি ধারা জামিন অযোগ্য।
মামলাটি বাতিলের দাবিতে দীর্ঘসময় আন্দোলন করে আসছেন অধিকার কর্মীরা
মত প্রকাশ অজামিনযোগ্য অপরাধ?
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মোট ৫৩ ধারার মধ্যে ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করা আছে।এগুলো হচ্ছে: ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪। আইনটি জারির পর থেকে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলায় একটি হলেও অজামিনযোগ্য ধারা রাখতে দেখা গিয়েছে।এ বিষয়ে মিস গুলরুখ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে কিন্তু সেগুলো ব্যবহার হয় জনস্বার্থে। কোন অপপ্রয়োগ হয় না।”কিন্তু বাংলাদেশে এই আইনের মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশকে ফৌজদারি অপরাধ বলা হচ্ছে। তাও আবার অজামিনযোগ্য অপরাধ। এজন্য মানুষ মাসের পর মাস জেল খাটছে। এটা কিভাবে হয়?”মানবাধিকার কর্মীর বলছেন, এই আইনের কারণে একদিকে যেমন সাংবাদিকতার চর্চা সংকুচিত হয়েছে সেইসাথে অনেক সাধারণ মানুষ এমনকি শিশুরাও নিপীড়নের শিকার হয়ে জেল খাটছেন।এই মানুষগুলোর অনেকেই তাদের অধিকার সম্পর্কে জানে না। এ কারণে আইনটি সাধারণ মানুষের জন্য কাল হয়ে দাঁড়িয়েছে।নওগাঁয় র্যাবের হাতে আটক নারীর মৃত্যু ‘হেফাজতে’ কিনা – এ প্রশ্নের জবাব কী?২৭ মার্চ ২০২৩
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন অপব্যবহারের অভিযোগ, বার বার শুধু সংশোধনের আশ্বাস
৩১ মার্চ ২০২৩ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন: অপপ্রয়োগ বন্ধে যেসব পরিবর্তন আনার কথা বলছে বাংলাদেশ সরকার
১ মার্চ ২০২১
সংশোধন নয় বাতিল
এমন সমালোচনার মুখে মানবাধিকারের জন্য জাতিসংঘের হাই-কমিশন গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি বিষয় সংশোধনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুপারিশ করে।সেগুলো হল: ভিন্নমত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, কথিত অপরাধ প্রতিরোধে ক্ষমতার ব্যাপকতা এবং জামিন-অযোগ্য ধারাগুলো মানেই হচ্ছে বিচারের আগেই দীর্ঘ সময় আটকে রাখা।আইনটি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও সংশোধনের দাবির মুখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়নে তেমন কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তার একটাই কথা, ওই সুপারিশমালা নিয়ে আলোচনা চলছে।এমন অবস্থায় আইনটি আদৌ সংশোধন করা হবে কি না, সেটা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।তাই মামলাটি আর সংশোধন নয়, বরং পুরোপুরি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন অনেক মানবাধিকার কর্মীা।মিস গুলরুখ আইনটিকে গণ-বিরোধী ও নিপীড়নমূলক আখ্যা দিয়ে বলেন, “যেকোনো আইন জন-নিরাপত্তার জন্য প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষা ও ক্ষমতা সংহত করার জন্য, মানুষের মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে বন্ধ করার জন্য। ফলে এই আইন জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই আইন বাতিল করতে হবে।”আইন অপপ্রয়োগের অভিযোগ অমূলক নয়
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির অপপ্রয়োগের অভিযোগ যে অমূলক নয় তা সাম্প্রতিক কয়েকটি মামলার ঘটনায় প্রতীয়মান হয়।সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ফ্রি খাদিজা নামে একটি প্রচারণা চলছে।এখানে খাদিজা, পুরো নাম খাদিজাতুল কুবরা হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।তিনিসহ মোট দুইজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১১ই অক্টোবর ঢাকার নিউমার্কেট থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ।দুই বছর মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হলে গত বছরের অগাস্টে মিস. কুবরা গ্রেফতার হন এবং আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, একটি ইউটিউব চ্যানেলের টক শোতে তিনি সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন, সেখানে এক বক্তা এবং মামলার অপর আসামী বর্তমান সরকারকে উৎখাতের বিষয়ে কথা বলেছিলেন।এসব ভিডিওর প্রচারের মাধ্যমে সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে সেইসাথে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়।তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫/২৯/৩১/৩৫ ধারা লঙ্ঘন করেছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে ৩১ ধারাটি অজামিনযোগ্য।এদিকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার আবু জামানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৯শে অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে তারই এক প্রভাবশালী প্রতিবেশী।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ফেসবুকে কুৎসা রটিয়ে স্ট্যাটাস লিখতে তিনি আরেক ব্যক্তিকে সহায়তা করেছেন।অথচ পঞ্চম শ্রেণী পাস কৃষক আবু জামানের কোন ফেসবুক আইডি নেই। তিনি স্মার্টফোনের ব্যবহারও জানেন না। মামলা ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।২০২০ সালের ১১ই এপ্রিল ফেসবুকে করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন সাংবাদিক ইখতিয়ার উদ্দীন আজাদ।মামলায় প্রায় নয় মাস কারাভোগের পর চলতি বছর বেকসুর খালাস পান তিনি। তার আইনজীবী তাকে মানহানির পাল্টা মামলা দায়েরের কথা বললেও তিনি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না।মামলার এজাহারে তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল, তিনি মিথ্যা তথ্য সম্বলিত ছবি ফেসবুকে প্রচার ও শেয়ার করে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন, জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি, ভয় ভীতি ও অস্থিরতা ছড়িয়েছেন।ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের খাবার পরিবেশনে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করায় এবং উপজেলায় ওএমএস ও খাদ্য-বান্ধব কর্মসূচির সরকারি চাল উদ্ধার নিয়ে ফেসবুক পোস্টের কারণে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি পৃথক মামলায় আসামী হয়েছেন সাংবাদিক রহিম শুভ।গত সপ্তাহে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করলেও আদালত তা খারিজ করে দেয়।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার লেখক মুশতাক আহমেদ কাশিমপুর কারাগারে আটক থাকা অবস্থাতেই মারা যান।
“রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশই মূল কারণ”
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা এমন শতাধিক মামলায় আসামী-পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল নোমান।এরমধ্যে একটি মামলাও তিনি পাননি যেখানে আসামী পক্ষের বিরুদ্ধে আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।এ বিষয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেসব সাংবাদিক আটক হয়েছেন তাদের বেশিরভাগ সরকারি লোকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করার দায়ে মামলার আসামী হয়েছেন। কিন্তু তারা যে খবর প্রকাশ করেছেন সেটা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতি মেনেই হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশ করার জন্যই তারা আজ কারাগারে।”তাও যদি কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে সেটা খতিয়ে দেখার জন্য প্রেস কাউন্সিল আছে। আর সাংবাদিকতার বাইরে অন্য পেশার কেউ হলে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হতে পারে।কিন্তু এভাবে ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করার এমন নজির পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।এ নিয়ে মি. নোমানের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল শুধুমাত্র ভিন্নমত দমনের টুল হিসেবে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করছে।এদিকে সাংবাদিকতার বাইরে যারা অন্য পেশায় আছেন বা খুব একটা পরিচিত মুখ নয় তারা বছরের পর বছর ধরে এই মামলার জটে জড়িয়ে পড়েছেন।এমনকি শিশুরাও এই মামলা থেকে রেহাই পাননি।তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন পোস্ট করা, শেয়ার বা কমেন্ট করা।এরমধ্যে রংপুরে এক কিশোরকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।করোনা মহামারীর সময় শেখ মুজিবের মাস্ক পরা একটি ছবি শেয়ার করার কারণে রংপুরে ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া ওই কিশোরকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে জেল হাজতে নেয়া হয়।পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারায় মামলা হয়।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ফেসবুকে শেয়ার হওয়া ওই ছবির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতাকে অবমাননা করা হয়েছে। ওই কিশোর এখন জামিনে মুক্ত হলেও ভয়ে রয়েছে।ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের বিরুদ্ধে বিক্ষোভ
প্রচলিত আইন ও সংবিধানের লঙ্ঘন
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণায় দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির অধীনে ২১ শিশু আটক এবং ২৬ শিশু অভিযুক্ত হয়েছে।শিশুদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে গত বছরের অগাস্টে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি পাঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম।ওই চিঠিতে তিনি বলেন, শিশু কিশোরদের বয়স বেশি দেখিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত মামলা দায়েরের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে কটূক্তি ছড়ানো, ধর্ম অবমাননা, এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জুয়া খেলার অভিযোগেও অল্প বয়সীদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে।এর মাধ্যমে শিশু আইন ২০১৩ এর বিধানাবলী সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেন।বাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।বাংলাদেশে মত প্রকাশে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সংবিধানে যে কয়টি শর্ত দেয়া হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার বেশিরভাগ মানুষ তার কোনটিই লঙ্ঘন করেনি বলে দাবি করেছেন আইনজীবী আবদুল্লাহ আল নোমান।এদিকে সামনে জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও তিনটি আইন–বিধির খসড়া তৈরির কাজ চলছে। সেগুলো হল কন্টেন্ট সুরক্ষা আইন, ওটিটি নীতিমালা এবং সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম প্রবিধান।এই তিনটি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।এই মামলায় সাংবাদিক হয়রানির বিষয়টি নিয়ে আলোচনা হলেও অন্য অনেকের ভোগান্তির কথা অনেকটা আড়ালেই থেকে যাচ্ছে।এমন অবস্থায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে একটি নিবর্তনমূলক আইন আখ্যা দিয়ে শুরু থেকেই আইনটি বাতিলের দাবি জানিয়ে আসছে আইনজীবী, ছাত্র-শিক্ষক, মানবাধিকারকর্মী ও বিভিন্ন নাগরিক সংগঠন।তাদের দাবি, ক্ষমতাসীন দলের লোকেরাই বিভিন্ন ব্যক্তির বিরুদ্ধে এই মামলাকে নিজেদের স্বার্থ রক্ষায় হাতিয়ার হিসেবে ব্যবহার করছে।মামলাটি বাতিলের দাবিতে দীর্ঘসময় আন্দোলন করে আসছেন অধিকার কর্মী ও লেখক সায়দিয়া গুলরুখ। তার মতে এই মামলার সবচেয়ে বিতর্কিত দুটি বিষয় হল এখানে মতপ্রকাশকে অপরাধ হিসেবে দেখা হয় এবং আইনের বেশ কয়েকটি ধারা জামিন অযোগ্য।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মোট ৫৩ ধারার মধ্যে ১৪টি ধারা অজামিনযোগ্য হিসেবে নির্দিষ্ট করা আছে।এগুলো হচ্ছে: ধারা ১৭, ১৯, ২১, ২২, ২৩, ২৪, ২৬, ২৭, ২৮, ৩০, ৩১, ৩২, ৩৩ ও ৩৪। আইনটি জারির পর থেকে এ পর্যন্ত দায়ের হওয়া অধিকাংশ মামলায় একটি হলেও অজামিনযোগ্য ধারা রাখতে দেখা গিয়েছে।এ বিষয়ে মিস গুলরুখ বলেন, বিশ্বের অনেক দেশেই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন আছে কিন্তু সেগুলো ব্যবহার হয় জনস্বার্থে। কোন অপপ্রয়োগ হয় না।”কিন্তু বাংলাদেশে এই আইনের মাধ্যমে মানুষের মত প্রকাশকে ফৌজদারি অপরাধ বলা হচ্ছে। তাও আবার অজামিনযোগ্য অপরাধ। এজন্য মানুষ মাসের পর মাস জেল খাটছে। এটা কিভাবে হয়?”মানবাধিকার কর্মীর বলছেন, এই আইনের কারণে একদিকে যেমন সাংবাদিকতার চর্চা সংকুচিত হয়েছে সেইসাথে অনেক সাধারণ মানুষ এমনকি শিশুরাও নিপীড়নের শিকার হয়ে জেল খাটছেন।
সংশোধন নয় বাতিল
এমন সমালোচনার মুখে মানবাধিকারের জন্য জাতিসংঘের হাই-কমিশন গত ফেব্রুয়ারি মাসে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের তিনটি বিষয় সংশোধনের জন্য বাংলাদেশ সরকারের কাছে সুপারিশ করে।সেগুলো হল: ভিন্নমত প্রকাশকে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা, কথিত অপরাধ প্রতিরোধে ক্ষমতার ব্যাপকতা এবং জামিন-অযোগ্য ধারাগুলো মানেই হচ্ছে বিচারের আগেই দীর্ঘ সময় আটকে রাখা।আইনটি নিয়ে দেশে-বিদেশে সমালোচনা ও সংশোধনের দাবির মুখে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক প্রয়োজনীয় পরিবর্তনের আশ্বাস দিলেও তা বাস্তবায়নে তেমন কোনও তৎপরতা দেখা যাচ্ছে না। তার একটাই কথা, ওই সুপারিশমালা নিয়ে আলোচনা চলছে।এমন অবস্থায় আইনটি আদৌ সংশোধন করা হবে কি না, সেটা নিয়ে সংশয় তৈরি হয়েছে।তাই মামলাটি আর সংশোধন নয়, বরং পুরোপুরি বাতিল করার দাবি জানিয়েছেন অনেক মানবাধিকার কর্মীা।মিস গুলরুখ আইনটিকে গণ-বিরোধী ও নিপীড়নমূলক আখ্যা দিয়ে বলেন, “যেকোনো আইন জন-নিরাপত্তার জন্য প্রণয়ন করা হয়। কিন্তু ডিজিটাল নিরাপত্তা আইন প্রণয়ন করা হয়েছে ক্ষমতাসীন দলের স্বার্থ রক্ষা ও ক্ষমতা সংহত করার জন্য, মানুষের মত প্রকাশের সাংবিধানিক অধিকারকে বন্ধ করার জন্য। ফলে এই আইন জন নিরাপত্তার জন্য হুমকি হয়ে দাঁড়িয়েছে। তাই এই আইন বাতিল করতে হবে।”
আইন অপপ্রয়োগের অভিযোগ অমূলক নয়
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির অপপ্রয়োগের অভিযোগ যে অমূলক নয় তা সাম্প্রতিক কয়েকটি মামলার ঘটনায় প্রতীয়মান হয়।সম্প্রতি সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে হ্যাশট্যাগ ফ্রি খাদিজা নামে একটি প্রচারণা চলছে।এখানে খাদিজা, পুরো নাম খাদিজাতুল কুবরা হলেন জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থী।তিনিসহ মোট দুইজনের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১১ই অক্টোবর ঢাকার নিউমার্কেট থানায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা করে পুলিশ।দুই বছর মামলার তদন্ত শেষে আদালতে চার্জশিট দাখিল করা হলে গত বছরের অগাস্টে মিস. কুবরা গ্রেফতার হন এবং আদালত তাকে কারাগারে পাঠানোর নির্দেশ দেন।তার আইনজীবী জামিনের আবেদন করলেও তা খারিজ হয়ে যায়।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, একটি ইউটিউব চ্যানেলের টক শোতে তিনি সঞ্চালকের ভূমিকায় ছিলেন, সেখানে এক বক্তা এবং মামলার অপর আসামী বর্তমান সরকারকে উৎখাতের বিষয়ে কথা বলেছিলেন।এসব ভিডিওর প্রচারের মাধ্যমে সরকারবিরোধী মনোভাব তৈরি করে দেশে অস্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করা হচ্ছে সেইসাথে বহির্বিশ্বে বাংলাদেশের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করা হচ্ছে বলে মামলায় অভিযোগ আনা হয়।তারা ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের ২৫/২৯/৩১/৩৫ ধারা লঙ্ঘন করেছেন বলে মামলার এজাহারে উল্লেখ করা হয়। এরমধ্যে ৩১ ধারাটি অজামিনযোগ্য।এদিকে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদি উপজেলার আবু জামানের বিরুদ্ধে ২০২০ সালের ১৯শে অক্টোবর ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে মামলা দায়ের করে তারই এক প্রভাবশালী প্রতিবেশী।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ফেসবুকে কুৎসা রটিয়ে স্ট্যাটাস লিখতে তিনি আরেক ব্যক্তিকে সহায়তা করেছেন।অথচ পঞ্চম শ্রেণী পাস কৃষক আবু জামানের কোন ফেসবুক আইডি নেই। তিনি স্মার্টফোনের ব্যবহারও জানেন না। মামলা ভয়ে পালিয়ে বেড়াতে হচ্ছে তাকে।২০২০ সালের ১১ই এপ্রিল ফেসবুকে করোনা ভাইরাস নিয়ে গুজব ছড়ানোর অভিযোগে গ্রেফতার হন সাংবাদিক ইখতিয়ার উদ্দীন আজাদ।মামলায় প্রায় নয় মাস কারাভোগের পর চলতি বছর বেকসুর খালাস পান তিনি। তার আইনজীবী তাকে মানহানির পাল্টা মামলা দায়েরের কথা বললেও তিনি কোন ঝামেলায় জড়াতে চাইছেন না।মামলার এজাহারে তার বিরুদ্ধে মূল অভিযোগ ছিল, তিনি মিথ্যা তথ্য সম্বলিত ছবি ফেসবুকে প্রচার ও শেয়ার করে রাষ্ট্রের ভাবমূর্তি ক্ষুণ্ণ করেছেন, জনসাধারণের মধ্যে বিভ্রান্তি, ভয় ভীতি ও অস্থিরতা ছড়িয়েছেন।ঠাকুরগাঁও সদর হাসপাতালে করোনা রোগীদের খাবার পরিবেশনে অনিয়মের অভিযোগ নিয়ে গণমাধ্যমে খবর প্রকাশ করায় এবং উপজেলায় ওএমএস ও খাদ্য-বান্ধব কর্মসূচির সরকারি চাল উদ্ধার নিয়ে ফেসবুক পোস্টের কারণে ফেসবুকে পোস্ট দেয়ায় ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের দুটি পৃথক মামলায় আসামী হয়েছেন সাংবাদিক রহিম শুভ।গত সপ্তাহে তার আইনজীবী জামিন আবেদন করলেও আদালত তা খারিজ করে দেয়।
ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে দায়ের করা এমন শতাধিক মামলায় আসামী-পক্ষের আইনজীবী হিসেবে কাজ করছেন সুপ্রিম কোর্টের অ্যাডভোকেট আবদুল্লাহ আল নোমান।এরমধ্যে একটি মামলাও তিনি পাননি যেখানে আসামী পক্ষের বিরুদ্ধে আইনের কোন ধারা লঙ্ঘন হওয়ার প্রমাণ মিলেছে।এ বিষয়ে তিনি বিবিসি বাংলাকে বলেন, “যেসব সাংবাদিক আটক হয়েছেন তাদের বেশিরভাগ সরকারি লোকদের দুর্নীতির বিরুদ্ধে খবর প্রকাশ করার দায়ে মামলার আসামী হয়েছেন। কিন্তু তারা যে খবর প্রকাশ করেছেন সেটা বস্তুনিষ্ঠ সাংবাদিকতার নীতি মেনেই হয়েছে। শুধুমাত্র রাজনৈতিক ভিন্নমত প্রকাশ করার জন্যই তারা আজ কারাগারে।”তাও যদি কোন সাংবাদিকের বিরুদ্ধে অভিযোগ থাকে সেটা খতিয়ে দেখার জন্য প্রেস কাউন্সিল আছে। আর সাংবাদিকতার বাইরে অন্য পেশার কেউ হলে তার বিরুদ্ধে মানহানির মামলা হতে পারে।কিন্তু এভাবে ফৌজদারি মামলায় গ্রেফতার করার এমন নজির পৃথিবীর কোথাও দেখা যায় না।এ নিয়ে মি. নোমানের অভিযোগ, ক্ষমতাসীন দল শুধুমাত্র ভিন্নমত দমনের টুল হিসেবে এই ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনকে ব্যবহার করছে।এদিকে সাংবাদিকতার বাইরে যারা অন্য পেশায় আছেন বা খুব একটা পরিচিত মুখ নয় তারা বছরের পর বছর ধরে এই মামলার জটে জড়িয়ে পড়েছেন।
এমনকি শিশুরাও এই মামলা থেকে রেহাই পাননি।
তাদের বেশিরভাগের ক্ষেত্রেই অভিযোগ সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে সরকারের বিরুদ্ধে যেতে পারে এমন পোস্ট করা, শেয়ার বা কমেন্ট করা।এরমধ্যে রংপুরে এক কিশোরকে কারাগারে পাঠানোর ঘটনা নিয়ে ব্যাপক আলোচনা হয়েছে।করোনা মহামারীর সময় শেখ মুজিবের মাস্ক পরা একটি ছবি শেয়ার করার কারণে রংপুরে ৮ম শ্রেণী পড়ুয়া ওই কিশোরকে গ্রেফতার করে হাতকড়া পরিয়ে জেল হাজতে নেয়া হয়।পরে তার বিরুদ্ধে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের চারটি ধারায় মামলা হয়।তার বিরুদ্ধে অভিযোগ ছিল, ফেসবুকে শেয়ার হওয়া ওই ছবির মাধ্যমে মুক্তিযুদ্ধ, মুক্তিযুদ্ধের চেতনা এবং জাতির পিতাকে অবমাননা করা হয়েছে। ওই কিশোর এখন জামিনে মুক্ত হলেও ভয়ে রয়েছে।
সেন্টার ফর গভর্ন্যান্স স্টাডিজের (সিজিএস) গবেষণায় দেখা যায়, ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনটির অধীনে ২১ শিশু আটক এবং ২৬ শিশু অভিযুক্ত হয়েছে।শিশুদের বিরুদ্ধে এই আইনে মামলা হওয়ার বিষয়ে উদ্বেগ জানিয়ে গত বছরের অগাস্টে জাতীয় মানবাধিকার কমিশনের চেয়ারম্যান বরাবর একটি চিঠি পাঠান বাংলাদেশ লিগ্যাল এইড সার্ভিসেস ট্রাস্ট-ব্লাস্টের আইন উপদেষ্টা এস এম রেজাউল করিম।
ওই চিঠিতে তিনি বলেন, শিশু কিশোরদের বয়স বেশি দেখিয়ে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে অভিযুক্ত মামলা দায়েরের প্রবণতা অনেক বেড়েছে। সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যমে কটূক্তি ছড়ানো, ধর্ম অবমাননা, এমনকি ইলেকট্রনিক ডিভাইস ব্যবহার করে জুয়া খেলার অভিযোগেও অল্প বয়সীদের বিরুদ্ধে এ আইনে মামলা হয়েছে।এর মাধ্যমে শিশু আইন ২০১৩ এর বিধানাবলী সেইসঙ্গে বাংলাদেশের সংবিধানে বর্ণিত ২৭, ৩১, ৩২ অনুচ্ছেদে বর্ণিত সাংবিধানিক অধিকারের সুস্পষ্ট লঙ্ঘন হচ্ছে বলে তিনি অভিযোগ করেনবাংলাদেশের সংবিধানের ৩৯ অনুচ্ছেদে মানুষের চিন্তা ও বিবেকের স্বাধীনতার নিশ্চয়তা দেয়া হয়েছে।বাংলাদেশে মত প্রকাশে স্বাধীনতার ক্ষেত্রে সংবিধানে যে কয়টি শর্ত দেয়া হয়েছে ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনে গ্রেফতার বেশিরভাগ মানুষ তার কোনটিই লঙ্ঘন করেনি বলে দাবি করেছেন আইনজীবী আবদুল্লাহ আল নোমান।এদিকে সামনে জাতীয় নির্বাচনের আগে আরও তিনটি আইন–বিধির খসড়া তৈরির কাজ চলছে। সেগুলো হল কন্টেন্ট সুরক্ষা আইন, ওটিটি নীতিমালা এবং সামাজিক যোগাযোগ-মাধ্যম প্রবিধান।এই তিনটি আইন ডিজিটাল নিরাপত্তা আইনের মত হবে বলে উদ্বেগ প্রকাশ করেছেন মানবাধিকার কর্মীরা।