ঢাকা , শনিবার, ৩০ নভেম্বর ২০২৪, ১৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১ বঙ্গাব্দ
শিরোনাম ::
Logo জগন্নাথপুরে জুলাই বিপ্লব ২৪ ডটকম এর আত্ম প্রকাশ Logo শান্তিগঞ্জে ‘আব্দুন নূর চেয়ারম্যান স্মৃতি প্রাথমিক মেধা বৃত্তির পরীক্ষা কাল শনিবার (৩০ নভেম্বর) Logo শান্তিগঞ্জে হাওরের ১০০ বছর ও আমাদের করণীয় শীর্ষক কর্মশালা Logo মধ্যনগরে আওয়ামী লীগ নেতার দখল থেকে সরকারী ভুমি পুনরুদ্ধার Logo সুনামগঞ্জের দিরাইয়ের রফিনগর গ্রামের সাজ্জাতুলের বাড়িঘরে হামলা,ভাংচুর লুটপাঠসহ মুক্তিযুদ্ধ স্মৃতিসৌধ ভাংচুরের ঘটনার প্রতিবাদে মানববন্ধন Logo বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনে আহত -নিহতদের স্মরণে দোয়ারাবাজারে স্মরণ সভা অনুষ্ঠিত Logo অন্তবর্তীকালীন সরকার পতনের ষড়যন্ত্র গোপন বৈঠকে থাকা ছাত্রলীগের ৩৮ নেতাকর্মীর বিরুদ্ধে মামলা, গ্রেফতার জেলা ছাত্রলীগের সহ সভাপতি Logo শান্তিগঞ্জে বিনামূল্যে গরু বিতরণের লক্ষ্যে অবহিতকরণ সভা ও প্রশিক্ষণ Logo দোয়ারাবাজারে সরকারি গাছ কর্তন।। জব্দ করলো প্রশাসন Logo শান্তিগঞ্জে আইনশৃঙ্খলা কমিটির মাসিক সভা 

অবিনাশী লোভে পুড়ছে সম্পদ নাকি অগ্নিসন্ত্রাসের ভিন্নরূপ

বৈশাখের তাপদাহে প্রাণ যেন যায়। প্রকৃতির কাছে মানুষ দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ডগুলো ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি দিয়ে চলছে একের পর এক। এরমধ্যে বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আতঙ্ক এবং সন্দেহকে একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। যখন সিটি করপোরেশন কিংবা সিভিল ডিফেন্স সার্ভিসের তথ্য দেখি, তখন হতবাক হয়ে যাই, যখন বিরোধী রাজনীতিবিদ ও কিছু সুশীলের বক্তব্য শুনি, অনিচ্ছাতে হলেও ক্ষোভ তৈরি হয়। সংকট কেন ওদিকে নজর না দিয়ে মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চায়- সবই সরকারি অবহেলা-অবজ্ঞা এবং দুর্নীতির ফল।
ক্ষোভ সন্দেহ আতঙ্ক যাই থাকুক, সেগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকুক কিংবা না থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে- বঙ্গবাজার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেই চুরিহাট্টা কিংবা নিমতলীর পথ ধরে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিছু মানুষের ভাগ্য। এই মুহূর্তে যত পোস্টমর্টেমই করা হোক না কেন, ভাগ্যাহতদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেওয়া এত সহজ হবে বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু পোস্টমর্টেমে ফয়দা হবে- এখনও যারা ঝুঁকির মুখে আছেন, যাদের ভাগ্য নিউমার্কেট কিংবা বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের মতো হওয়ার আশঙ্কা বেশি, তাদের বিপদমুক্ত থাকার পথ পাওয়া যেতে পারে।
যে মুহূর্তে নিউমার্কেটে আগুন নিভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপক বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আপ্রাণ লড়াই করছে, ওই সময়ই একবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মন্তব্যও কানে ধাক্কা দেয়। ভাবতে হয়, মানুষের মানসিকতা, বিশ্বাস এবং আচরণ সত্যিই কৌতূহল সৃষ্টিকারক। যে মুহূর্তে নিউমার্কেট জ্বলছিল, পাড়ার মুদি দোকানে গিয়েছিলাম সদাই করতে। তার কথা, সাংবাদিক সাব, যতদিন খাই খাই বন্ধ না হইবো ততদিন আল্লাহর গজব চলবোই। একই মুখে অন্য বক্তব্য বেরিয়ে এলো- আসলে বঙ্গবাজার দখল করার জন্য আগুন দেওয়া হইছে। কী সুন্দর চৌকি বসানো হইয়া গেছে। এরপর কিছু বাম হাত ডান হাত ইত্যাদি। এরপর হয়তো বলা হবে বহুতল ভবন হবে। বেশ টাকা আর টাকা। টেন্ডার চলবে ইত্যাদি।
ঢাকার এই ক্ষুদ্র দোকানির এই মন্তব্য আসলে প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠীরই অন্ধবিশ্বাসের কথা। জরিপ নিলে দেখা যাবে- শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা হবে, আসলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই কাজে জড়িত। কারণ, তারা লুটেপুটে খাওয়ার আশায় এমন কাজটি করেছে।
বঙ্গবাজারে যখন ১৯৯৫ সালে আগুন লেগেছিল তখনও মানুষ একই কথা বলেছিল। আবার ২০২৩ সালে যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তখনও একই কথা শোনা যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৯৫ সালেও আগুন লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়নি। এবারও বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়নি। কিংবা ঈদের বাজার জমজমাট অবস্থায় শনিবার নিউমার্কেট আগুনে তছনছ হয়ে গেলো, সেখানেও উচ্ছেদ কিংবা দখলের সম্ভাবনা নেই। তবে এমন ঘটনার জেরে যা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা হচ্ছে সন্দেহ এবং সরকারের বিরুদ্ধে একটা অজুহাত তৈরির সুযোগ।
এবার দেখা যাক এমন বাজারগুলোর অবস্থা সম্পর্কে তদারককারী সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মন্তব্য কী। এবং তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে কিনা। ঢাকা শহরে শপিং মল, বাজার, ভবন, জনবসতি কিংবা জনব্যবহারে ঝুঁকিমুক্ত কিনা তার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের অধীনস্থ বাজারগুলোর বিষয়ে আলাদাভাবে সিটি করপোরেশনও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী এই ঢাকা শহরেই ৬২২টি মার্কেট অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং  ৬৭৮টি বাজার ঝুঁকিপূর্ণ। এই মার্কেটগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এসব বাজার/শপিং মলে আসে নিজেদের প্রয়োজনে।
যদি বাজারে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকার পর আল্লাহ না করুন কোথাও আগুন লেগে যায়, মানুষের জীবন রক্ষা করা কি সম্ভব হবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করেও? যে মুহূর্তে এই নিবন্ধ লেখা হচ্ছে তখন নিউ মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিন্তু যে অর্ধসহস্র বাজারে এই নিবন্ধ লেখাকালেই হাজার হাজার মানুষ ব্যস্ত আছেন কেনাকাটায়, তারা জানেও না ওই বাজারগুলোই হতে পারে যে কারও জন্য প্রাণসংহারী। কিন্তু এটা ঠিক, বাজারগুলোর অধিকাংশ ব্যবসায়ীই জানেন তাদের বাজারটি আসলে মৃত্যুফাঁদ। যেকোনও সময় এই ফাঁদে ধরা খেতে পারে মানুষ। আর সেই আগুন, ভূমিকম্প কিংবা বর্ষণজনিত কারণে ভবন ধসের শিকার তিনি নিজেও হতে পারেন।
বঙ্গবাজার ভস্মীভূত হওয়ার সময় বলা হয়েছিল এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে সিটি করপোরেশন থেকে বারবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি তাদের বলা হয়েছিল পরিকল্পিত ভবন নির্মাণ করে দেবে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তারা মানেনি। সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলে তারা আদালতে গেছে।
প্রায় একই অবস্থা আমরা দেখতে পারি নিউমার্কেটসহ ঢাকার শত শত বাজারের ক্ষেত্রে। এই নিউমার্কেট সম্পর্কেও আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল সিভিল ডিফেন্স। সাময়িক ক্ষতিকে মেনে নিতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, তারা সরকারি উদ্যোগে বাধা প্রদান করে নিজেদের সাময়িক লাভকে বড় করে দেখেছে। আজকে যে বিশাল এবং অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো, তা কি সামাল দিতে পারবেন বঙ্গবাজার এবং নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
চুরিহাট্টা, নিমতলী, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটের মতো ক্ষতিকে কি আমরা স্বাগত জানাতে পারি? নিশ্চয়ই না। তাহলে? সে জন্য যেসব মার্কেট ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের দ্রুত নোটিশ দেওয়া হোক। একবার দুইবার তিনবার নোটিশ দিয়ে কাজ না হলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক। মনে রাখা প্রয়োজন, এক হাজার দুই হাজার দোকানের সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার তুলনায় এক দুইটা প্রাণ চলে যাওয়া হাজার হাজারগুণ বেশি ক্ষতিকর। এখন এসব বাজার ভবন জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। জীবনের প্রয়োজনেই সরকারকে কঠোর হতে হবে। দুই চার জন ব্যবসায়ী রাজপথে মিছিল করবে, এমন আশঙ্কায় যদি অতি ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-বাজারগুলো টিকিয়ে রাখা হয়, তাহলে আরও বড় কোনও ক্ষতিও ঘটে যেতে পারে।
একই সঙ্গে শহরকে প্রকৃতির অনুকূল জায়গা হিসেবেও গড়ে তোলা অপরিহার্য। ২ কোটিরও বেশি মানুষের বসত এই ঢাকা। জনতার চাপে ঢাকার মাটি তটস্থ। সরু রাস্তাঘাট যেমন জনবসতি হিসেবে ঝুঁকি বাড়ায় তেমনি এখানকার জলাশয়গুলো ধ্বংস করার প্রতিযোগিতাও গণমৃত্যুর আশঙ্কাকে দ্রুততর করে। দিনে দিনে ঢাকার ভেতরে এবং পাশের জলাধারগুলো ভরাট করা হচ্ছে, মাইলের পর মাইল অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা হচ্ছে আর বিপদের সম্ভাবনা ঘনিষ্ঠতর করছে। নিউ মার্কেটের কাছাকাছি পুকুর ছিল ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে পানি নেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবাজারের আশপাশে পুকুর থেকে ওভাবে পানি নেওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকার পুকুরগুলো সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঢাকার ভেতরে থাকা ঝিলগুলো প্রতিযোগিতা করে দখল করা হচ্ছে। সেগুলো অবৈধভাবে ভরাট করে দোকান কিংবা বাড়ি বানানো হচ্ছে। ঢাকা শহরকে জলাধারশূন্য নগরে পরিণত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এই ধ্বংসযজ্ঞগুলোকে এক অর্থে মানবসৃষ্ট বলাও অযৌক্তিক হবে না।দ্রষ্টব্য- নিউমার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক পোস্ট দেখা যাচ্ছে- ঈদের পূর্বক্ষণে একের পর এক মার্কেটে আগুন, অগ্নিসন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি নয়তো?

ট্যাগস
আপলোডকারীর তথ্য

Janasarthe 24

আপনাদের আশে পাশে ঘটে যাওয়া প্রতি মুহুর্তের খবর দিয়ে আমাদের সহযোগীতা করুন। আমরা আমাদের অনলাইনে তা প্রকাশ করে কৃতজ্ঞ হবো। আমাদের প্রতি মুহুর্তের খবর জানতে আমাদের সাথে থাকুন
জনপ্রিয় সংবাদ

জগন্নাথপুরে জুলাই বিপ্লব ২৪ ডটকম এর আত্ম প্রকাশ

অবিনাশী লোভে পুড়ছে সম্পদ নাকি অগ্নিসন্ত্রাসের ভিন্নরূপ

আপডেট সময় ০১:২৩:৪৩ অপরাহ্ন, রবিবার, ১৬ এপ্রিল ২০২৩

বৈশাখের তাপদাহে প্রাণ যেন যায়। প্রকৃতির কাছে মানুষ দিশেহারা। এমন পরিস্থিতিতে অগ্নিকাণ্ডগুলো ভূমিকম্পের ঝাঁকুনি দিয়ে চলছে একের পর এক। এরমধ্যে বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটের মতো গুরুত্বপূর্ণ বাজার এলাকায় অগ্নিকাণ্ডের ঘটনা আতঙ্ক এবং সন্দেহকে একধাপ বাড়িয়ে দিয়েছে। যখন সিটি করপোরেশন কিংবা সিভিল ডিফেন্স সার্ভিসের তথ্য দেখি, তখন হতবাক হয়ে যাই, যখন বিরোধী রাজনীতিবিদ ও কিছু সুশীলের বক্তব্য শুনি, অনিচ্ছাতে হলেও ক্ষোভ তৈরি হয়। সংকট কেন ওদিকে নজর না দিয়ে মানুষ দ্রুত সিদ্ধান্ত নিতে চায়- সবই সরকারি অবহেলা-অবজ্ঞা এবং দুর্নীতির ফল।
ক্ষোভ সন্দেহ আতঙ্ক যাই থাকুক, সেগুলোর যৌক্তিকতা নিয়ে তর্ক-বিতর্ক থাকুক কিংবা না থাকুক, বাস্তবতা হচ্ছে- বঙ্গবাজার নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে, সেই চুরিহাট্টা কিংবা নিমতলীর পথ ধরে। পুড়ে ছাই হয়ে গেছে কিছু মানুষের ভাগ্য। এই মুহূর্তে যত পোস্টমর্টেমই করা হোক না কেন, ভাগ্যাহতদের ভাগ্য ফিরিয়ে দেওয়া এত সহজ হবে বলে মনে করার কোনও কারণ নেই। কিন্তু পোস্টমর্টেমে ফয়দা হবে- এখনও যারা ঝুঁকির মুখে আছেন, যাদের ভাগ্য নিউমার্কেট কিংবা বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের ভাগ্যের মতো হওয়ার আশঙ্কা বেশি, তাদের বিপদমুক্ত থাকার পথ পাওয়া যেতে পারে।
যে মুহূর্তে নিউমার্কেটে আগুন নিভানোর জন্য অগ্নিনির্বাপক বাহিনীসহ বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান আপ্রাণ লড়াই করছে, ওই সময়ই একবারে তৃণমূল পর্যায়ের মানুষের মন্তব্যও কানে ধাক্কা দেয়। ভাবতে হয়, মানুষের মানসিকতা, বিশ্বাস এবং আচরণ সত্যিই কৌতূহল সৃষ্টিকারক। যে মুহূর্তে নিউমার্কেট জ্বলছিল, পাড়ার মুদি দোকানে গিয়েছিলাম সদাই করতে। তার কথা, সাংবাদিক সাব, যতদিন খাই খাই বন্ধ না হইবো ততদিন আল্লাহর গজব চলবোই। একই মুখে অন্য বক্তব্য বেরিয়ে এলো- আসলে বঙ্গবাজার দখল করার জন্য আগুন দেওয়া হইছে। কী সুন্দর চৌকি বসানো হইয়া গেছে। এরপর কিছু বাম হাত ডান হাত ইত্যাদি। এরপর হয়তো বলা হবে বহুতল ভবন হবে। বেশ টাকা আর টাকা। টেন্ডার চলবে ইত্যাদি।
ঢাকার এই ক্ষুদ্র দোকানির এই মন্তব্য আসলে প্রায় সমগ্র জনগোষ্ঠীরই অন্ধবিশ্বাসের কথা। জরিপ নিলে দেখা যাবে- শুধু ঢাকা নয়, সারা দেশের অধিকাংশ মানুষেরই ধারণা হবে, আসলে ক্ষমতাসীন দলের নেতারা এই কাজে জড়িত। কারণ, তারা লুটেপুটে খাওয়ার আশায় এমন কাজটি করেছে।
বঙ্গবাজারে যখন ১৯৯৫ সালে আগুন লেগেছিল তখনও মানুষ একই কথা বলেছিল। আবার ২০২৩ সালে যখন পুড়ে ছাই হয়ে গেছে তখনও একই কথা শোনা যাচ্ছে। বাস্তবতা হচ্ছে ১৯৯৫ সালেও আগুন লাগিয়ে ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়নি। এবারও বঙ্গবাজারের ব্যবসায়ীদের উচ্ছেদ করা হয়নি। কিংবা ঈদের বাজার জমজমাট অবস্থায় শনিবার নিউমার্কেট আগুনে তছনছ হয়ে গেলো, সেখানেও উচ্ছেদ কিংবা দখলের সম্ভাবনা নেই। তবে এমন ঘটনার জেরে যা শক্তিশালী ভিত্তির ওপর প্রতিষ্ঠিত তা হচ্ছে সন্দেহ এবং সরকারের বিরুদ্ধে একটা অজুহাত তৈরির সুযোগ।
এবার দেখা যাক এমন বাজারগুলোর অবস্থা সম্পর্কে তদারককারী সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানগুলোর মন্তব্য কী। এবং তারা তাদের দায়িত্ব যথাযথ পালন করেছে কিনা। ঢাকা শহরে শপিং মল, বাজার, ভবন, জনবসতি কিংবা জনব্যবহারে ঝুঁকিমুক্ত কিনা তার প্রাথমিক সিদ্ধান্ত দিয়ে থাকে সিভিল ডিফেন্স সার্ভিস। পাশাপাশি সিটি করপোরেশনের অধীনস্থ বাজারগুলোর বিষয়ে আলাদাভাবে সিটি করপোরেশনও সিদ্ধান্ত নিয়ে থাকে। সেই অনুযায়ী এই ঢাকা শহরেই ৬২২টি মার্কেট অতি ঝুঁকিপূর্ণ এবং  ৬৭৮টি বাজার ঝুঁকিপূর্ণ। এই মার্কেটগুলোর সঙ্গে জড়িয়ে আছে হাজার হাজার মানুষের বেঁচে থাকার প্রশ্ন। প্রতিদিন হাজার হাজার মানুষ এসব বাজার/শপিং মলে আসে নিজেদের প্রয়োজনে।
যদি বাজারে হাজার হাজার মানুষ উপস্থিত থাকার পর আল্লাহ না করুন কোথাও আগুন লেগে যায়, মানুষের জীবন রক্ষা করা কি সম্ভব হবে বাংলাদেশের সর্বোচ্চ ক্ষমতা প্রয়োগ করেও? যে মুহূর্তে এই নিবন্ধ লেখা হচ্ছে তখন নিউ মার্কেটের আগুন নিয়ন্ত্রণে এসেছে কিন্তু যে অর্ধসহস্র বাজারে এই নিবন্ধ লেখাকালেই হাজার হাজার মানুষ ব্যস্ত আছেন কেনাকাটায়, তারা জানেও না ওই বাজারগুলোই হতে পারে যে কারও জন্য প্রাণসংহারী। কিন্তু এটা ঠিক, বাজারগুলোর অধিকাংশ ব্যবসায়ীই জানেন তাদের বাজারটি আসলে মৃত্যুফাঁদ। যেকোনও সময় এই ফাঁদে ধরা খেতে পারে মানুষ। আর সেই আগুন, ভূমিকম্প কিংবা বর্ষণজনিত কারণে ভবন ধসের শিকার তিনি নিজেও হতে পারেন।
বঙ্গবাজার ভস্মীভূত হওয়ার সময় বলা হয়েছিল এটিকে ঝুঁকিপূর্ণ হিসেবে সিটি করপোরেশন থেকে বারবার নোটিশ দেওয়া হয়েছিল। এমনকি তাদের বলা হয়েছিল পরিকল্পিত ভবন নির্মাণ করে দেবে সিটি করপোরেশন। কিন্তু তারা মানেনি। সিটি করপোরেশন উদ্যোগ নিলে তারা আদালতে গেছে।
প্রায় একই অবস্থা আমরা দেখতে পারি নিউমার্কেটসহ ঢাকার শত শত বাজারের ক্ষেত্রে। এই নিউমার্কেট সম্পর্কেও আগাম সতর্কবার্তা দিয়েছিল সিভিল ডিফেন্স। সাময়িক ক্ষতিকে মেনে নিতে নারাজ ব্যবসায়ীরা। শুধু তাই নয়, তারা সরকারি উদ্যোগে বাধা প্রদান করে নিজেদের সাময়িক লাভকে বড় করে দেখেছে। আজকে যে বিশাল এবং অপূরণীয় ক্ষতি হয়ে গেলো, তা কি সামাল দিতে পারবেন বঙ্গবাজার এবং নিউমার্কেটের ব্যবসায়ীরা।
চুরিহাট্টা, নিমতলী, বঙ্গবাজার, নিউমার্কেটের মতো ক্ষতিকে কি আমরা স্বাগত জানাতে পারি? নিশ্চয়ই না। তাহলে? সে জন্য যেসব মার্কেট ভবনকে অতি ঝুঁকিপূর্ণ ঘোষণা করা হয়েছে, তাদের দ্রুত নোটিশ দেওয়া হোক। একবার দুইবার তিনবার নোটিশ দিয়ে কাজ না হলে গুঁড়িয়ে দেওয়া হোক। মনে রাখা প্রয়োজন, এক হাজার দুই হাজার দোকানের সম্পদ বিনষ্ট হওয়ার তুলনায় এক দুইটা প্রাণ চলে যাওয়া হাজার হাজারগুণ বেশি ক্ষতিকর। এখন এসব বাজার ভবন জীবনের জন্যও ঝুঁকিপূর্ণ। জীবনের প্রয়োজনেই সরকারকে কঠোর হতে হবে। দুই চার জন ব্যবসায়ী রাজপথে মিছিল করবে, এমন আশঙ্কায় যদি অতি ঝুঁকিপূর্ণ কিংবা ঝুঁকিপূর্ণ ভবন-বাজারগুলো টিকিয়ে রাখা হয়, তাহলে আরও বড় কোনও ক্ষতিও ঘটে যেতে পারে।
একই সঙ্গে শহরকে প্রকৃতির অনুকূল জায়গা হিসেবেও গড়ে তোলা অপরিহার্য। ২ কোটিরও বেশি মানুষের বসত এই ঢাকা। জনতার চাপে ঢাকার মাটি তটস্থ। সরু রাস্তাঘাট যেমন জনবসতি হিসেবে ঝুঁকি বাড়ায় তেমনি এখানকার জলাশয়গুলো ধ্বংস করার প্রতিযোগিতাও গণমৃত্যুর আশঙ্কাকে দ্রুততর করে। দিনে দিনে ঢাকার ভেতরে এবং পাশের জলাধারগুলো ভরাট করা হচ্ছে, মাইলের পর মাইল অপরিকল্পিত আবাসন ব্যবস্থা হচ্ছে আর বিপদের সম্ভাবনা ঘনিষ্ঠতর করছে। নিউ মার্কেটের কাছাকাছি পুকুর ছিল ঢাকা কলেজে। সেখান থেকে পানি নেওয়া সম্ভব হয়েছে। কিন্তু বঙ্গবাজারের আশপাশে পুকুর থেকে ওভাবে পানি নেওয়া সম্ভব হয়নি। ঢাকার পুকুরগুলো সবই নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে। ঢাকার ভেতরে থাকা ঝিলগুলো প্রতিযোগিতা করে দখল করা হচ্ছে। সেগুলো অবৈধভাবে ভরাট করে দোকান কিংবা বাড়ি বানানো হচ্ছে। ঢাকা শহরকে জলাধারশূন্য নগরে পরিণত করা হচ্ছে। এমন পরিস্থিতিতে এই ধ্বংসযজ্ঞগুলোকে এক অর্থে মানবসৃষ্ট বলাও অযৌক্তিক হবে না।দ্রষ্টব্য- নিউমার্কেটে অগ্নিকাণ্ডের পর থেকে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে একের পর এক পোস্ট দেখা যাচ্ছে- ঈদের পূর্বক্ষণে একের পর এক মার্কেটে আগুন, অগ্নিসন্ত্রাসের পুনরাবৃত্তি নয়তো?