জিয়াউর রহমান লিটন : ফজলুর রহমান। একজন বীর যোদ্ধার নাম। যিনি শুধু নিজে যুদ্ধ করেননি বরং রণাঙ্গনে যুদ্ধ পরিচালনার গুরু দায়িত্বও পালন করেছেন। আজন্মই একজন যোদ্ধা তিনি।
‘সমরে আমরা, শান্তিতে আমরা, সর্বত্র আমরা দেশের তরে’ এই প্রত্যয় ব্যক্তকারীদের একজন তিনি।সেনাবাহিনীর এক সিংহ পুরুষের নাম ফজলুর রহমান। ১৯৬৭ সালে পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে যোগদান করেছিলেন।
আর্মি অর্ডন্যান্স কোর’র কর্পোরাল পরে জুনিয়র কমিশন্ড অফিসার হন তিনি। সেনাবাহিনীতে যোগ দিয়েই পাকিস্তানীদের বৈষম্যের বিরুদ্ধে প্রতিবাদে সোচ্চার হন।
পাকিস্তান সেনাবাহিনীতে পশ্চিম পাকিস্তানীদের তুলনায় পূর্ব পাকিস্তানীদের সংখ্যা ছিলো খুব কম। শুধু সেনাবাহিনী নয় সকল ক্ষেত্রেই সরকারি সুযোগ সুবিধা থেকে তুলনামূলক বঞ্চিত হচ্ছিলেন পূর্ব পাকিস্তানীরা। এতে প্রকাশ্যে ক্ষিপ্ত হয়ে উঠেন তিনি।
তখন ১৯৬৮ সাল। ঘটনাস্থল করাচির মালিক ক্যাম্প ডিপো। তখন মাসিক দরবার চলছিলো। ওই সময়ে পাকিস্তানী সেনাকর্মকর্তাদের চোখ রাঙানো উপেক্ষা করে একটি আবেদন করেন ফজলুর রহমান।
জনসংখ্যার হারে পশ্চিম এবং পূর্ব পাকিস্তান থেকে সেনাবাহিনীতে সৈনিক নিয়োগের আবেদন জানান এই সৈনিক। ওই ইউনিটের বাঙালি কর্মকর্তা এবং সৈনিকরা সেদিন অবাক হন তাঁর সাহসিকতায়।
কিন্তু তার আবেদন জমা দেয়ার পরপরই কৌশলে দরবার মূলতবি ঘোষণা করা হয় । পরবর্তীতে বাঙালি অন্যান্য সৈনিকরা ফজলুর রহমানকে উৎসাহ দিয়েছেন।
দেশপ্রেমের প্রথম মশাল এভাবেই প্রজ্জ্বলিত করেন ফজলুর রহমান। মুক্তিযুদ্ধ শুরুর আগে এভাবেই যেন প্রথম যুদ্ধের সূচনা করেন তিনি।
মুক্তিযুদ্ধের প্রাক্কালে ফজলুর রহমান ছুটিতে ছিলেন। করাচি যাওয়ার পথে ঢাকা ট্রানজিট ক্যাম্পে অবস্থান নেন। অনুভূত হচ্ছিল পরিস্থিতি ক্রমশ্য জটিল হচ্ছে। এ অবস্থায় করাচি যাওয়া ঠিক হবে কি-না ভেবে পাচ্ছিলেন না। তৎকালীন বিপ্লবী ছাত্রনেতা সিরাজুল আলম খানের সঙ্গে ছিলো তাঁর ঘনিষ্ট সম্পর্ক। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের তখনকার ইকবাল হলে থাকতেন সিরাজুল আলম খান। তাঁর সাথে দেখা করেন ফজলুর রহমান।
সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সাক্ষাত করেন।এ বিষয়ে ফজলুল রহমান বলেন, ‘দিন-তারিখ মনে নেই। তবে মার্চ মাসের ১৫ তারিখের পরে পরিস্থিতি খারাপ দেখে শেখ সাহেবের সাথে তাঁর বাসায় দেখা করি।’ তিনি তখন শেখ সাহেবের কাছে জানতে চান তাঁর কর্মস্থল পশ্চিম পাকিস্তানে এই মুহূর্তে তিনি যাবেন কি-না?
বঙ্গবন্ধু বলেন ‘আমরা যদি ক্ষমতা না পাই তাহলে আপনাদের চাকুরি থাকবে না। আমরা ক্ষমতায় গেলে আপনাদের চাকুরি থাকবে। পরিস্থিতি ভালো না। আপনারা ঢাকায় থাকেন। অপেক্ষা করেন। রাজনৈতিকভাবে এর সমাধান হবে।’
ফজলুর রহমান জানান, সিরাজুল আলম খানের পরামর্শে ঢাকা ক্যান্টমেন্টে পশ্চিম পাকিস্তানীদের প্রতিদিনের খবর সংগ্রহ করে তাঁকে জানাতেন। খবর সংগ্রহ করতে গিয়ে ২৪ মার্চ ধরা পড়ে যান তিনি। পাকিস্তানী আর্মিরা তাঁকে সাধারণ মানুষ মনে করে জোড় করে গাড়িতে তুলে বিমানবন্দরে নিয়ে যায়। সারা দিন তাঁকে দিয়ে বিমানবন্দরে কুলির কাজ করানো হয়। সন্ধ্যায় তাকে ছেড়ে দেয় পাকিস্তানী আর্মিরা। ওই দিন আর সিরাজুল আলম খানের সাথে তাঁর দেখা হয়নি। ফজলুর রহমান বলেন ‘সেদিন পাকিস্তানী আর্মিরা যদি আমার পরিচয় পেতো তাহলে জীবিত থাকতাম কি-না জানিনা।’
২৫ মার্চ রাতে রাজারবাগ পুলিশ হেড কোয়াটারে হামলা চালায় পাকিস্তানী আর্মিরা। ফজলুর রহমান বলেন ‘তখন আমি ভিষণ দুশ্চিন্তায় পড়ি। কী করবো ভেবে পাই না। কোনোক্রমে ক্যাম্প থেকে বের হয়ে পাশ্ববর্তী সাগুরা গ্রামে (গাজীপুরের) যাই। ’ ফজলুর রহমান আরও বলেন, ভাবছিলাম বাড়িতে (সিলেট) চলে যাব। ওইখানে স্থানীয়দের সাথে কথা হয়। নারী-পুরুষ সবাই অনুনয় করে- আপনারা আর্মি হয়ে যদি বাড়িতে চলে যান। তাহলে আমাদের কী হবে?
তিনি বলেন, ‘পরবর্তীতে শুনতে পাই মেজর জিয়া সাহেব বিদ্রোহ ঘোষণা করেছেন। তখন প্রচন্ড সাহস পাই।’ ওই সময়ে তিনি জানতে পারেন সেনাবাহিনীর চার নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণ বাড়িয়া থেকে বিদ্রোহ ঘোষণা করেছে।
তাৎক্ষণিকভাবে ঠিক করেন সেখানে যাবেন। নরসিংদী জেলা সদরের জলিল নামক আওয়ামীলীগ কর্মী তাঁকে চার নম্বর বেঙ্গল রেজিমেন্ট ব্রাহ্মণ বাড়িয়া পৌঁছে দেন। সেখান থেকে ওই রেজিমেন্টের সৈনিকরা হবিগঞ্জের তেলিয়াপাড়ায় জড়ো হন।
তেলিয়াপাড়া থেকে ভারতের আর্মিদের সহযোগিতায় রামগড় হয়ে চট্রগ্রাম পোঁছেন ফজলুর রহমানসহ ৪২ জনের একটি মুক্তিকামী সশ্রস্ত্র দল। এদের মধ্যে ৩৯ জনই ছিলেন সেনাবাহিনীর সৈনিক বাকী তিন জন ছিলেন তৎকালীন বিডিআর’র সদস্য।
চার নম্বর রেজিমেন্টের সদস্য ছিলেন ক্যাপ্টেন মতিন। সেক্টর হওয়ার পর দুই ও পাঁচ নম্বর সেক্টরে যুদ্ধ করেছেন ফজলুর রহমান। ক্যাপ্টেন মতিনের অধীনে প্রথম যুদ্ধ করেন চট্রগ্রাম টিবি হাসপাতাল এলাকায়। তার আগে পর্যায়ক্রমে চট্রগ্রামের ওয়ারলেস সেন্টার, সিতাকুন্ড, বারকুন্ড এলাকায় সম্মুখ যুদ্ধ করেছেন ফজলুর রহমান। চট্রগ্রামে যুদ্ধকালে তাঁর একজন সহযোদ্ধা বিডিআর’র এক সদস্য শহীদ হন। অন্যদিকে অনেক পাকসেনা নিহত হয় তাদের হামলায়। তবে তাঁর প্রথম গেরিলা যুদ্ধ নোয়াখালী জেলার ছাগল নাইয়ায়।
এ ব্যাপারে ফজলুর রহমান বলেন ‘যুদ্ধকালে আমাদের মর্টার পরিচালনার লোকের প্রয়োজন ছিলো। তাই ক্যাপ্টেন মতিন সাহেবের নির্দেশে আমি ভারতের অম্পিনগর ট্রেনিং সেন্টার থেকে তিন ইঞ্চি ২১ মিলিমিটার’র শিক্ষা গ্রহণ করি।’
তারপর কর্ণেল মীর শওকত আলী’র অধীনে পাঁচ নম্বর সেক্টরে যোগদান করেন তিনি। সেখানে সুনামগঞ্জের সীমান্তবতী এলাকায় জয়বাংলা নগরে থেকে তিন ইঞ্চি মর্টারের যুদ্ধ পরিচালনা করেন ফজলুর রহমান। বিজয়ের পূর্ব পর্যন্ত তিনি সেখানে থেকে যুদ্ধ করেছেন। স্বাধীনতার পর দীর্ঘদিন বাংলাদেশ সেনাবাহিনীতে কর্মরত ছিলেন।
বর্তমানে সুনামগঞ্জের দিরাই পৌরসদরের পূর্ব দিরাই এলাকায় সপরিবারে বসবাস করছেন এই বীর মুক্তিযোদ্ধা। বর্তমান বাংলাদেশ সম্পর্কে তিনি বলেন ‘আমরা এ দেশের মানুষের শান্তি ও সমৃদ্ধির জন্য যুদ্ধ করেছি। জনগণের অধিকার প্রতিষ্ঠার জন্য যুদ্ধ করেছি। কিন্তু আজও আমাদের স্বপ্ন পূরণ হয়নি।’ এই বীর যোদ্ধার সরল বক্তব্য- ‘লাগামহীন দুর্নীতি আরও শোষকদের এই দেশ আমি চাইনি। কোনো মুক্তিযোদ্ধার কাছেই এটি প্রত্যাশিত ছিল না।’